সর্বশেষ
[glt-translator]
Home » শিক্ষা » নতুন কারিকুলামে সপ্তম শ্রেণির শরীফার গল্প নিয়ে কেন এই বিতর্ক?

নতুন কারিকুলামে সপ্তম শ্রেণির শরীফার গল্প নিয়ে কেন এই বিতর্ক?

নতুন কারিকুলামে সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের একটি অধ্যায় নিয়ে দেশব্যাপী আলোচনা-সমালোচনা চলছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফরমে এর পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন অনেকে সম্প্রতি জাতীয় শিক্ষক ফোরামের এক সেমিনারে এ বইয়ের ‘শরীফার গল্প’র সমালোচনা করতে গিয়ে বইয়ের পাতা ছিঁড়ে প্রতিবাদ জানান ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ মাহতাব উৎস। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে চাকরি হারান ওই শিক্ষক। মূলত এরপরই বিষয়টি আলোচনায় আসে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বলছে, এটি কেবল মানুষের লিঙ্গ বৈচিত্র্যতা বোঝাতে যুক্ত করা হয়েছে। যাতে করে ছেলে-মেয়েরা বিষয়গুলো বুঝে তাদের সহপাঠীর প্রতি সহনশীল হতে পারে। কারণ সপ্তম শ্রেণি থেকেই একজন ছেলেমেয়ের শারীরিক পরিবর্তন শুরু হয়। এদিকে বিতর্কের মুখে গতকাল এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কমিটিকে দ্রুত সময়ের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছে, যেকোনো কিছু পাঠ্য বইয়ে যুক্ত করার আগে আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিশ্বাসকে আমলে নিয়ে সচেতনতার সঙ্গে যুক্ত করা উচিত। তা না হলে এ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
অন্যদিকে জেন্ডার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তৃতীয় লিঙ্গ বলতে আসলে কিছু নেই। পুরুষ-নারীর বাইরে হিজড়া, সমকামি, রূপান্তরকামী সবাইকে এক করেই ট্রান্সজেন্ডার বোঝানো হয়। ট্রান্সজেন্ডার শব্দটি সার্বজনীনতাকে প্রতিনিধিত্ব করে। যেটি হিজড়া সম্প্রদায়ও মেনে নিতে চায় না। তারা আলাদা থাকতে চায়। হিজড়া কমিউনিটি বলছে, ট্রান্সজেন্ডারের কারণে তাদের সম্মান ক্ষুণ্ন হচ্ছে। মানুষ তাদের সম্পর্কেও নেতিবাচক ধারণা পোষণ করছে। তাই তারা ট্রান্সজেন্ডারে বিশ্বাসী না। সাধারণ মানুষের চলমান প্রতিবাদকে তারা সমর্থন করেন। আর ট্রান্সজেন্ডার কমিউনিটি বলছে, চলমান বিতর্কের কারণে তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে ‘শরীফার গল্পের উপস্থাপনা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রফেসর ড. মো. আব্দুস সালাম বলেন, আমাদের এখানে নতুন কিছু আসলে মেনে নেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। শ্রেণিভেদে কন্টেন্ট নির্বাচন করা উচিত। যেখানে এনসিটিবির সীমাবদ্ধতা আছে। আরও সচেতন হতে হবে। উপস্থাপনায় দক্ষতা না থাকলে গল্পের মোটিভ ঠিক থাকে না। যেটি শরীফার গল্পে দেখা গেছে। এখানে হিজড়া বোঝাতে গিয়ে ‘মনে মনে’ বলা হয়েছে যেটি উদ্দেশ্য না। লেখনীর সঙ্গে উদ্দেশ্য এক হয়নি। তাই নতুন কিছু যুক্ত করার আগে আমি মনে করি এনসিটিবি’র তিনটা প্যানেল থাকা উচিত। এদের একটা হবে গল্প বিশেষজ্ঞ, দ্বিতীয়টি পর্যালোচনা করবে- এভাবে কমিটি কাজ করবে। কারণ তাড়াহুড়ার কারণে ছোট ছোট ভুল এনসিটিবি’র ইমেজ নষ্ট করে। মানুষ ভুল বোঝে। তাই ভুল ত্রুটি দূর করে ফাইনাল প্রিন্টে যাওয়া উচিত। শরীফার গল্প মূলত লিঙ্গ বৈচিত্র্যতাকে ইতিবাচকভাবে দেখার জন্য দেয়া হয়েছে।
রাজধানীর মিরপুর এলাকায় হিজড়াদের গুরুমাতা হিসেবে দায়িত্বপালন করছেন রাখি শেখ। যিনি স্বপ্নধারা ফাউন্ডেশন নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনেরও সাধারণ সম্পাদক। ট্রান্সজেন্ডার ইস্যুতে মানবজমিনকে তিনি বলেন, আমরা কোনো ভাবেই এদের মানি না ও পছন্দ করি না। এদের জন্য হিজড়া সম্প্রদায়ের সম্মান নষ্ট হচ্ছে। ওরা সমকামিতা ও বাজে আচরণের জন্য স্বীকৃতি চাচ্ছে। আমরা এটার জন্য প্রতিবাদ করতে চাই। আমরা মনে করি বর্তমানে সাধারণ মানুষ যে আন্দোলন করছে তা অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত। আমরা সাধারণ মানুষের পক্ষে। তিনি বলেন, স্বীকৃতি দিয়েছে হিজড়া সম্প্রদায়কে। ট্রান্সজেন্ডার গোষ্ঠীকে বাজে কাজ করার জন্য স্বীকৃতি দেয়া হয়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের প্রফেসর ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা সেন্টার ফর জেন্ডার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক ড. তানিয়া হক মানবজমিনকে বলেন, ট্রান্সজেন্ডার ও থার্ড জেন্ডার গবেষণাভিত্তিক তাত্ত্বিক বিষয়। মূলত ট্রান্সজেন্ডারের মধ্যে সবাইকে মিলে একটা নামকরণ করা হচ্ছিলো। যার মধ্যে গে, লেসবিয়ান, হিজড়া সবাইকে রাখা হয়েছে। যদিও হিজড়ারা বলতে চাচ্ছে তারা আলাদা। সেটা সময়সাপেক্ষে বের হয়ে আসবে। এই যে, এখন যে রকম অনেকে বুঝে- না বুঝে কথা বলছি। অনেকে আবেগ কিংবা ধর্মীয় জায়গা থেকে কথা বলছি। এটাকেও সহনশীলতার দৃষ্টিতে দেখতে হবে। একটা মানুষ হয়তো তার আবেগ কিংবা বিবেক থেকে একটা কথা বলেই ফেলছে তার জায়গাটাকেও একেবারে ছুঁড়ে ফেলে না দিয়ে কিংবা ধিক্কার না দিয়ে স্বাভাবিক সলিড সলিউশনে আমরা পৌঁছাই।

তিনি আরও বলেন, প্রত্যেকেরই ভিন্ন ভিন্ন মত থাকতে পারে তাই বলে আমি তাকে ধিক্কার দেবো সেই অধিকার আমার নেই। প্রত্যেকে তার নিজস্ব মতাদর্শে চলে, তবে আরও বেশি সহনশীল হওয়া উচিত। এখানে (শরীফার গল্পে) বৈচিত্র্যতাকে বোঝানোর জন্য সপ্তম শ্রেণির বইতে আনা হয়েছে। থার্ড জেন্ডারও আমাদের সোসাইটিতে আছে। কারণ ছোটবেলা থেকে না বুঝালে বড় হয়ে আমরা সেটি গ্রহণ করতে পারি না। সেই জায়গা থেকে এ মানুষটার চিত্র দেয়া হয়েছে। তাই বিষয়টি নিয়ে ভিন্ন ব্যাখ্যা, ভিন্ন মতামত পোষণ করার মানুষ থাকবে- এটাই স্বাভাবিক।

এনসিটিবি চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. ফরহাদুল ইসলাম বলেন, থার্ড জেন্ডার ইসলামে স্বীকৃত। আর ট্রান্সজেন্ডারকে মিশর, মালেশিয়াসহ কয়েকটি ইসলামিক রাষ্ট্র অনুমোদন করেছে। আমরা গত বছর ট্রান্সজেন্ডার দিয়েছি এবার সেটাকে সংশোধন করে থার্ড জেন্ডার লেখেছি। থার্ড জেন্ডারে কোনো সমস্যা না। তারপরও শরীফার গল্প নিয়ে কেন বিতর্ক হচেচ্ছ তার জন্য কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই রিপোর্টের আলোকে মন্ত্রণালয় নির্দেশনা দিলে আমরা ঠিক করে নেবো। তিনি বলেন, শরীফার গল্প অনেকে বলছে কেন সেভেনে দিয়েছি? আমাদের যুক্তি হলো- সেভেন থেকেই এ বিষয়টা (শারীরিক পরিবর্তন) ছেলে মেয়েদের মধ্যে অনুভূত হয়। তাই তখন থেকে যেন সে বুঝতে পারে বিষয়টা এবং সহপাঠীদের সঙ্গে সহনশীল আচরণ করে তাই বিষয়টি দেয়া। প্রফেসর ফরহাদুল ইসলাম বলেন, শরীফার গল্পে এমন কোনো উপাদান নেই যা আমাদের সমাজ ও ধর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তারপর তা যদি সোসাইটিকে আঘাত করে থাকে তাই কমিটি গঠন করা। গল্পটি আসলে আমাদের মূল্যবোধ কিংবা সোসাইটির বাইরে চলে গেছে কিনা সেটা কমিটি দেখবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *