দেশে সংসার ভেঙে যাওয়ার সংখ্যা বাড়ছে। পুরুষের তুলনায় দ্বিগুণ তালাক হচ্ছে নারীর মাধ্যমে। পরকীয়া, যৌতুক, মাদকাসক্তি, নির্যাতনসহ বিভিন্ন সমস্যায় বাড়ছে বিবাহবিচ্ছেদ। সংসার জীবনে নারী-পুরুষ উভয়ই তালাকে খুঁজছেন মুক্তি। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ধনী-গরিব সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ হচ্ছে। অনেকে ছোটখাটো বিষয় থেকেই তালাকের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, বর্তমান সময়ে তালাকে এগিয়ে রয়েছে নারীরা। একটা সময় নারীদের পুরুষদের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হতো। বেশির ভাগ নারীরা এখন উপার্জনক্ষম। নারীরা শিক্ষা ও অর্থনৈতিকভাবেও অনেকটা এগিয়ে। সংসার জীবনে নারীদের দ্বারাও অনেক সমস্যা দেখা যায়। দু’পক্ষের মধ্যে ঘটিত নানাবিধ সমস্যার সমাধান না হলে গড়ায় বিচ্ছেদে।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের এক হিসাবে দেখা গেছে নারীরা তালাকের রেকর্ড করেছেন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) তথ্য মতে, ২০২০ সালে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মোট তালাকের আবেদন পড়েছে ৬ হাজার ১৬৮টি। এর মধ্যে নারী করেছেন ৪ হাজার ৫৩টি আর পুরুষ করেছেন ২ হাজার ১১৫টি। মোট তালাক কার্যকর হয়েছে ৩ হাজার ৪৪২টি। ২০২১ সালে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মোট তালাকের আবেদন পড়েছে ৭ হাজার ৪১৪টি। ৪ হাজার ৮১টি আবেদন করেছেন নারী। আর ১ হাজার ৭৬২টি আবেদন করেছেন পুরুষ। এ বছরে মোট তালাক কার্যকর হয়েছে ৪ হাজার ৬৭৪টি। ২০২২ সালে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মোট তালাকের আবেদন পড়েছে ৫ হাজার ৫৯০টি। ৩ হাজার ৬৩৭টি আবেদন করেছেন নারী। আর ২ হাজার ২টি আবেদন করেছেন পুরুষ। মোট তালাক কার্যকর হয়েছে ৪ হাজার ২১১টি। ২০২৩ সালে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মোট তালাকের আবেদন পড়েছে ৬ হাজার ৩৯৯টি। ৪ হাজার ১৮২টি তালাকের আবেদন করেছেন নারী। আর ২ হাজার ২১৭টি আবেদন করেছেন পুরুষ। এ বছরে মোট তালাক কার্যকর হয় ৩ হাজার ৪৩৫টি। ২০২৪ সালে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মোট তালাকের আবেদন পড়েছে গড়ে ২ হাজার ৫২১টি। ১ হাজার ৫৬১টি তালাকের আবেদন করেছেন নারীরা। আর ৯৬০টি আবেদন করেছেন পুরুষ। মোট তালাক কার্যকর হয় ১ হাজার ৫০৮টি। এ সিটিতে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে গত পাঁচ বছরে মোট তালাকের আবেদন পড়েছে ২৮ হাজার ৯২টি। এর মধ্যে পুরুষরা আবেদন করেছেন ৯ হাজার ৫৬টি এবং নারীরা করেছেন ১৭ হাজার ৫১৪টি।

একইভাবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) গত পাঁচ বছরে তালাকের আবেদন পড়েছে ৩৬ হাজার ৫০৭টি। এর মধ্যে ২৬ হাজার ৪৪টি আবেদন করেছেন নারীরা আর ১০ হাজার ৪৬৩টি আবেদন করেছেন পুরুষ। ডিএসসিসি’র তথ্য মতে, ২০২০ সালে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তালাকের আবেদন পড়েছে ৬ হাজার ৩৪৫টি। ৪ হাজার ৪২৮টি আবেদন করেছেন নারী। আর এ বছরে ১ হাজার ৯১৭টি আবেদন করেছেন পুরুষ। ২০২১ সালে মোট তালাকের আবেদন পড়েছে ৭ হাজার ২৪৫টি। ৫ হাজার ১৮৩টি আবেদন করেন নারী। আর ২ হাজার ৬২টি আবেদন করেন পুরুষ। ২০২২ সালে মোট তালাকের সংখ্যা ৭ হাজার ৬৯৮টি। নারীরা করেছেন ৫ হাজার ৩৮৩টি। আর পুরুষ ২ হাজার ৩১৫টি। ২০২৩ সালে মোট তালাকের আবেদন ৭ হাজার ৩০৬টি। নারীরা করেছেন ৫ হাজার ২৮৬টি। আর পুরুষ ২ হাজার ২০টি। ২০২৪ সালে মোট তালাকের আবেদন সংখ্যা ৭ হাজার ৯১৩টি। নারীরা করেছেন ৫ হাজার ৭৬৪টি। পুরুষ আবেদন করেছেন ২ হাজার ১৪৯টি।

দুই সিটিতে নারীদের করা আবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়া, ভরণ-পোষণ না দেয়া, স্বামীর সন্দেহবাতিক মনোভাব, কাবিন না হওয়া, স্বামী মাদকাসক্তি, যৌতুক, নির্যাতন, মানসিক পীড়ন, পরকীয়া, আর্থিক সমস্যা, বেপরোয়া জীবনযাপন, বদমেজাজ, সংসারের প্রতি উদাসীনতা, সন্তান না হওয়া, টিকটকসহ সামাজিক মাধ্যমে অবাধ বিচরণ করাসহ বিভিন্ন কারণে ঘটছে বিচ্ছেদের ঘটনা।

এ বিষয়ে দুই সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নারী বা পুরুষ যে কারও কাছ থেকে যখন তালাকের অভিযোগটি আসে তখন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দুই পক্ষকে নিয়ে সমাধানের চেষ্টা করেন। যেন এটি তালাকের পর্যায়ে না গিয়ে একটি সুন্দর পরিবেশ তৈরি বা সংসারটি যাতে টিকে যায় সেই চেষ্টা থাকে। আবেদনকারীদের নিয়ে কয়েকটি শুনানি হয়, একাধিকবার বসে। যখন দেখা যায় কেউই শুনতে চাচ্ছে না বা সংসার করতে আগ্রহী না, সর্বশেষ পর্যায়ে গিয়ে তালাকের সিদ্ধান্তে আসে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম মানবজমিনকে বলেন, ‘তালাক’ শব্দটি খুবই নীতিবাচক। কে কার সঙ্গে থাকবে না এটি একজন মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। খুবই ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কারোরই মাথা ঘামানো উচিত না। দু’টি মানুষের মাঝে এমন কি পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে যে তারা আলাদা হয়ে যাচ্ছে- এটি তাদের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে লক্ষণীয় যেটা, আগে আমরা দেখেছি কথায় কথায় ছেড়ে দিতে পারতো নারীকে, সেখানে দেশে নারীদের উন্নয়নে বিয়ে সংক্রান্ত, চাইল্ড কাস্টুরি এসকল জায়গায় যে আইনগুলো আছে সেগুলো পর্যায়ক্রমে যখন যে রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় এসেছে তারা কিন্তু বিভিন্নভাবে এই আইনগুলো বেশ নারীবান্ধব করে তুলেছে। এবং নারীবান্ধব শুধু করেইনি নারীদেরকেও সচেতন করেছে। এক্ষেত্রে বেসরকারি সংগঠন, সরকারি পর্যায় একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা, স্থানীয় সরকার কর্তৃক সেমিনার হচ্ছে, টেলিভিশনে সচেতনতামূলক নাটক হচ্ছে। তিনি বলেন, মাদকাসক্তি একটা ভয়াবহ কারণ। অনেক মেয়ে জেনেও বিয়ে করছে। যখন দেখছে সে প্রতিনিয়ত নেশায় আসক্ত স্বামীর দ্বারা মারধরের শিকার হচ্ছে, তখন কিন্তু সে থাকতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে সেই মেয়ের পরিবারও নিজ থেকে মেয়েকে রক্ষা করছে। অনেকে ডিভোর্স নিচ্ছে, কেবলমাত্র সে যে সাবলম্বী হয়েছে, তার একটা মাথা গোজার ঠাঁই হয়েছে সেটা না পরিবারও কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে তার ভাই-বাবা বা তার চাচা-মামা কারও না কারও দ্বারা মানসিকভাবে হেয় হচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, আমাদের পরিবারভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় বিবাহ অপরিহার্য। আমরা বিবাহটাকে আইনগত ও সামাজিকভাবে একটা স্বীকৃত মাধ্যম হিসেবে পরিবার গঠনের একটা পূর্ব পর্যায় মনে করি। সেক্ষেত্রে এই পরিবার গঠনে সহনশীলতার অভাব কিংবা নারীর প্রতি নির্যাতন, মাদকাসক্তি, পরকীয়া নানাবিধ ঘটনা ঘটছে। এমন কিছু কিছু ঘটনা একটা পর্যায়ে গিয়ে বিষাক্ত করে তোলে সংসার জীবন। নারী-পুরুষ যেই হোক, বিবাহবিচ্ছেদ ঘটলে সমাজব্যবস্থা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। সেই ঝুঁকির মাত্রাটা তাদের সন্তান এবং পরিবারে প্রবীন ব্যক্তিদের মধ্যে বেশি প্রভাব বিস্তার ও ক্ষতিগ্রস্ত করে। তাদের উপরেও একটা নীতিবাচক প্রভাব তৈরি হয়।
আইনজীবী কেএম মাহফুজ মিশু বলেন, বর্তমান সময়ে অনেক তরুণ-তরুণী পুলিশি ঝামেলা এড়াতে পড়াশোনা অবস্থায় পরিবারকে না জানিয়ে বিয়ে করছে। এই ধরনের মানুষগুলোর মধ্যে কিছুদিন যেতে না যেতেই ডিভোর্স হচ্ছে। যারা আমাদের কাছে আসেন, তাদের মধ্যে দেখা যায় একে অপরকে সম্মান না করা ছাড়া আরও অসংখ্য কারণ দেখান। দুই পক্ষ থেকে আমরা প্রথমে কথা শোনার চেষ্টা করি। এরপর বোঝাই যাতে তাদের সংসারটি টিকে থাকে। অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায়, গোপনে যেমন বিয়ে হচ্ছে তেমনি গোপনে ডিভোর্সও হয়ে যাচ্ছে। তাদের কোনো পরিবারই জানছে না বিষয়গুলো। পারিবারিকভাবে বিয়ে যারা করছেন তাদের সংখ্যা খুবই কম দেখা যাচ্ছে। চাইলেই নারী-পুরুষ উভয়ই তালাক দিতে পারে, তবে সংখ্যায় দেখা যাচ্ছে, নারীর দ্বারা ডিভোর্স বেশি হচ্ছে। একটি সম্পর্কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পারস্পরিক সম্মানবোধ থাকা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, স্বামী-স্ত্রী দু’জনই কেউ কাউকে বুঝতে চায় না। হেয় করে একে অপরের সঙ্গে কথা বলে। তিনি বলেন, আমার কাছে তালাকের বিষয় নিয়ে যারা আসেন তাদের দীর্ঘদিন ধরে বুঝাতে চেষ্টা করি। অনেকের সংসার টিকে যায় আবার অনেকে শেষমেশ সিদ্ধান্তই নিয়ে নেয় ডিভোর্সের।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here