নির্বাচনী আচরণবিধিমালায় সংশোধন আনা হচ্ছে। আচরণবিধিতে প্রথমবারের মতো যুক্ত হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার। নির্বাচনী প্রচারণায় থাকছে না পোস্টার। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে প্রতি ৭ দিন অন্তর নির্বাচনী ব্যয়ের হিসাব রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে দাখিল করতে হবে। জনসভা করতে হলে ৭২ ঘণ্টা আগে নিতে হবে পুলিশের অনুমতি। যুক্ত করা হয়েছে প্রার্থিতা বাতিলের বিধান। প্রস্তাবিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন আচরণ বিধিমালা, ২০২৫ এর খসড়ায় এসব বিধান রাখা হয়েছে। ইসি সূত্র জানায়, খসড়া আচরণ বিধিমালার নির্বাচনী প্রচারের অংশে বলা হয়েছে, কোনো প্রার্থী বা তার এজেন্ট বা অন্য কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা পরিচালনা করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ডিজিটাল বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নাম, অ্যাকাউন্ট ও ই-মেইল আইডিসহ অন্যান্য শনাক্তকরণ তথ্য প্রচার-প্রচারণা শুরুর আগে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে দাখিল করতে হবে। তবে ডিজিটাল বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নির্বাচনী প্রচারণাকালে ব্যক্তিগত চরিত্রহনন করে কোনো বক্তব্য বা বিবৃতি, কোনো ধরনের তিক্ত বা উস্কানিমূলক বা মানহানিকর কিংবা লিঙ্গ সাম্প্রদায়িকতা বা ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগে এমন কোনো বক্তব্য বা বিবৃতি প্রদান, কনটেন্ট বানানো ও প্রচার করা যাবে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারে মানহানিকর প্রচার করলে ডিজিটাল বা সাইবার সুরক্ষা আইনের আওতায় শাস্তি হবে। এ ছাড়া ভোটগ্রহণ শুরু হওয়ার ৪৮ ঘণ্টা আগেই অনলাইন প্রচারণা থেকে বিরত থাকতে হবে।
খসড়ার নির্বাচনী ব্যয়সীমা সংক্রান্ত বাধা-নিষেধে বলা হয়েছে, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল কিংবা দলের মনোনীত প্রার্থী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী কিংবা তাদের পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি নির্বাচনী বিষয়ক সামাজিক মাধ্যমে কনটেন্ট তৈরি, বিজ্ঞাপন প্রদান, বুস্টিং ও স্পন্সরশিপসহ সকল ডিজিটাল প্রচারণা ব্যয় শিরোনামে সামগ্রিক নির্বাচনী ব্যয়ের সঙ্গে নির্বাচন কমিশন বরাবর দাখিল করতে হবে। সামাজিক মাধ্যমে সমস্ত ব্যয়সমূহ প্রার্থীদের নির্বাচনী ব্যয়সীমার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে। সামাজিক প্রচার অভিযানে বিদেশি অর্থায়নে বিজ্ঞাপন বা প্রচারণা কার্যক্রম চালাতে পারবে না। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে প্রতি ৭ দিন অন্তর নির্বাচনী ব্যয়ের হিসাব রিটার্নিং কর্মকর্তা/সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে দাখিল করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণা-বিধি লঙ্ঘিত হলে ডিজিটাল/সাইবার সুরক্ষা আইনের আওতায় শাস্তি প্রযোজ্য হবে।
এদিকে খসড়া আচরণ বিধিমালায় সরকারি সুবিধাভোগী গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির তালিকায় নতুন করে উপদেষ্টা ও তাদের সমমর্যাদার ব্যক্তিদের যুক্ত করা হয়েছে। আচরণ বিধিমালার খসড়ায় নির্বাচনের সময়কে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার দিন থেকে তফসিল পর্যন্ত সময়কে নির্বাচন-পূর্ব সময়, তফসিল ঘোষণা থেকে ফলাফল গেজেট আকারে প্রকাশের সময়কে নির্বাচনকালীন সময় এবং ফলাফলের গেজেট প্রকাশের পর থেকে ৪৫ দিন পর্যন্ত সময়কে নির্বাচন-পরবর্তী সময় উল্লেখ করা হয়েছে। খসড়ায় প্রচারে পোস্টার বাতিল করে ব্যানার শব্দ রাখা হয়েছে। ব্যানারের অর্থ বোঝানো হয়েছে কাপড়ের তৈরি প্রচারপত্র। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহৃত ব্যানার সাদা-কালো রঙের ও আয়তন অনধিক ৩ মিটার বাই ১ মিটার হবে এবং ব্যানারে প্রার্থী তার প্রতীক ও নিজের ছবি ব্যতীত অন্য কোনো ব্যক্তির ছবি বা প্রতীক ছাপাতে পারবে না। তবে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মনোনীত হলে তিনি তার বর্তমান দলীয় প্রধানের ছবি লিফলেট বা হ্যান্ডবিলে ছাপাতে পারবে। প্রচারপত্রে পলিথিনের আবরণ বা প্লাস্টিক ব্যানার লেমিনেটিং ব্যবহার করা যাবে না। জনসভার দিন, সময় ও স্থানের বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ন্যূনতম ৭২ ঘণ্টা আগে লিখিত অনুমতি নিতে হবে। জনসভার কমপক্ষে ৪৮ ঘণ্টা আগে স্থান ও সময় সম্পর্কে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে জানাতে হবে। রিটার্নিং অফিসারের নিকট মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় ৫ জনের অধিক থাকতে পারবে না। এদিকে নির্বাচনী প্রচারণার জন্য প্রার্থীর ছবি বা তার পক্ষে ক্যাপ ব্যবহার করা যাবে না।
খসড়ায় বিলবোর্ড ব্যবহার সংক্রান্ত বাধা-নিষেধ যুক্ত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, নির্বাচনী প্রচারণার ক্ষেত্রে কোনো প্রকারের স্থায়ী বা অস্থায়ী বিলবোর্ড ভূমি বা অন্য কোনো কাঠামো বা বৃক্ষ ইত্যাদিতে স্থাপন বা ব্যবহার করা যাবে না। ওদিকে মাইক ব্যবহারের ক্ষেত্রে শব্দের মান ৬০ ডেসিবেল রাখার এবং বেলা ২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার বিধান রাখা হয়েছে খসড়ায়। যেটা আগে ছিল রাত ৮টা পর্যন্ত।
সরকারি সুবিধাভোগীদের নির্বাচনী প্রচারণার ক্ষেত্রে খসড়ায় বলা হয়েছে, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদে পূর্বে সভাপতি বা সদস্য হিসেবে নির্বাচিত বা মনোনীত হয়ে থাকলে বা তৎকর্তৃক কোনো মনোনয়ন প্রদত্ত হয়ে থাকলে নির্বাচন-পূর্ব সময়ে তিনি বা তৎকর্তৃক মনোনীত ব্যক্তি উক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো সভায় সভাপতিত্ব বা অংশগ্রহণ করবে না অথবা উক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো কাজে জড়িত হবে না। নির্বাচনী প্রচারণার সময়কাল শুরু হওয়ার আগেই উক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে।
খসড়ায় নতুন করে প্রার্থিতা বাতিলের বিধান যুক্ত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, যদি কোনো উৎস থেকে প্রাপ্ত রেকর্ড কিংবা লিখিত রেকর্ড হতে কমিশনের নিকট প্রতীয়মান হয় যে, প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো প্রার্থী বা তার নির্বাচনী এজেন্ট এই বিধিমালার কোনো বিধান লঙ্ঘন করেছে বা লঙ্ঘনের চেষ্টা করেছে এবং অনুরূপ লঙ্ঘন বা লঙ্ঘনের চেষ্টার জন্য তিনি নির্বাচনের অযোগ্য হতে পারেন, তাহলে কমিশন বিষয়টি সম্পর্কে তাৎক্ষণিক তদন্তের নির্দেশ দিতে পারবে। তদন্ত রিপোর্ট প্রাপ্তির পর কমিশন যদি মনে করেন আচরণবিধি লঙ্ঘন হয়েছে, সেক্ষেত্রে কমিশন উক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর প্রার্থিতা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর বিধান মোতাবেক বাতিল করতে পারবেন। খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, রাজনৈতিক দলসমূহ এই আচরণবিধির সকল বিধান মেনে চলবে মর্মে একটি প্রত্যয়নপত্র নির্বাচন কমিশনে প্রতীক বরাদ্দের পূর্বে দাখিল করবে।
গত সোমবার এ সংক্রান্ত কমিটির বৈঠক শেষে নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, খসড়াটি প্রায় চূড়ান্ত। এখন নির্বাচন কমিশনে উপস্থাপনের প্রক্রিয়া নেয়া হবে। ইসি অনুমোদন দিলে ফাইনালি পাবলিশড হবে। তিনি বলেন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের অধিকাংশ সুপারিশ প্রস্তাবিত আচরণবিধিতে যুক্ত করা হয়েছে। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনাগুলো আছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও গণমাধ্যমে আসা অন্যান্য বিষয়গুলো ইনকরপোরেট করার উদ্যোগ নিয়েছি। একটা চমৎকার আচরণবিধিমালা হবে-এটা প্রত্যাশা।