অনলাইন গেমে আসক্ত হয়ে পড়ছে আমাদের দেশের অপার সম্ভাবনাময় শিশুরা। মেধা আর মননে শিশুদের বিকশিত হবার অন্তরায় হয়ে উঠছে এই আসক্তি। পরিণামে অসহায় হয়ে পড়ছেন বাবা-মা, অশান্তি নেমে আসছে পারিবারিক জীবনে। অনলাইন গেমের এই আসক্তি থেকে শিশুদের রক্ষা করতেই হবে।
নাটোর সরকারি বালক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্র মাহমুদুল হক মাহী জানায়, বাবা-মা’র অনুরোধে নিজেকে অনলাইন গেম খেলা থেকে নিবৃত্ত করলেও সহপাঠিদের পরিমণ্ডলে গেলে শুধু অনলাইন গেমেরই আলোচনা। গেমের কে কোন পর্যায়ে আছে, কিভাবে খরচ নির্বাহ হচ্ছে, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী ইত্যাদি। এই আলোচনায় আমি এলোমেলো হয়ে যাই। মনে হয়, ওরা স্মার্ট, আমি পিছিয়ে পড়া।
একই স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র শিহাব পঞ্চম শ্রেণীতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিল। দুই বছর ধরে অনলাইন গেমে আসক্ত হয়ে প্রতিদিন চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা সময় জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। এখন নিজের মাথার চুল টেনে টেনে নিজেই ছেঁড়ে। এ বছর জেএসসি পরীক্ষা না হওয়াতে যেন হাফ ছেড়ে বেঁচেছে। অসহায় ওর শিক্ষক বাবা-মা।
একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তাসনুভা রহমান বলেন, মোবাইল গেমে আসক্ত ছেলে তৌকির কোনোরকমে পড়াশুনায় মাধ্যমিক পর্যায় অতিক্রম করলেও ওর ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি চিন্তিত। আমাকে ছেড়ে মাদকাসক্তের কারণে ডিভোর্স হয়ে যাওয়া ওর বাবার কাছে ফিরে যেতে রাজী, তবুও তিনি এই গেম ছাড়তে পারবেনা বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে!
অনলাইন গেমে প্রাণ গেছে দেশ-বিদেশের অসংখ্য শিশু-কিশোরের। সম্প্রতি নাটোরের লালপুরে রেল লাইনে বসে মোবাইল ফোনের গেমে মত্ত ছিল এক কিশোর। কখন যে ট্রেন এসে গেছে। ফলাফল ঘটনাস্থলেই প্রাণ গেছে কিশোরের।
দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিশু-কিশোররা এখন পাবজি, ফ্রি-ফায়ার, ক্ল্যাশ অর ক্ল্র্যান্স, কল অব ডিউটি, কমব্যাট স্ট্রাইক গো ইত্যাদি অনলাইন গেমে আসক্ত। এসব গেম খেলতে গুগল একাউন্ট বা ফেসবুক আইডি দিয়ে সাইন-ইন করতে হয়। ইন্টারনেট সংযোগ ছাড়াও গেমের ব্রোঞ্জ, সিলভার, গোল্ড, প্লাটিনাম, ডায়মন্ড, হিরোইক ও গ্রান্ড মাস্টার পর্যায়ে যেতে টাকা খরচ করে কিনতে হয় টপ-আপ অর্থাৎ খেলার পোশাকসহ বিভিন্ন সামগ্রী। এই খাতে এক থেকে দশ হাজার টাকার পকেট কাটা যায় অভিভাবকের।
নাটোরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আইনজীবী জানান, সম্প্রতি আমার বিকাশ একাউন্ট থেকে ৪৩ হাজার টাকা উধাও হয়ে যায়। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ুয়া আমার ছোট ছেলে অনলাইন গেম খেলার সামগ্রী কিনতে ওই টাকা সংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তির মাস্টার কার্ডে পাঠিয়েছে। পুলিশের সহায়তায় ওই টাকার কিছুটা উদ্ধার করি।
করোনাকাল যেন শিশুদের জন্যে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সব বন্ধ থাকাতে বাড়িতে বদ্ধ পরিবেশে শিশুরা অভ্যস্ত হয়ে উঠছে অনলাইন গেমে। আর অভ্যস্তরা আরো সক্রিয় হয়ে উঠেছে এই ক্ষেত্রে। এই অঙ্গনে আসক্ত শিশুদের বাবা-মা’রা বড্ড অসহায়, কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
কেন এমন হয়? নিজেদের কর্মে ব্যস্ত বাবা-মা’রা সময় দিতে পারেন না সন্তানদের। এর পরিবর্তে তাদের হাতে তুলে দেন মোবাইল ফোন বা অন্য কোনো ডিভাইস। এভাবেই শিশুদের এই জগতে প্রবেশ। আবার অনেক অভিভাবক মনে করেন, তাদের সন্তান প্রযুক্তির অনেক জানে-এটা গর্বের। এভাবেই শিশুরা আসক্ত হচ্ছে অনলাইন গেমে।
আর অনলাইন গেমে আসক্ত শিশু-কিশোররা মনে করে, গেম খেলতে খেলতে দক্ষ হয়ে উঠলে উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানে এক সময় সফটওয়ার তৈরী করতে আমাদের ডাক পড়বে। বিদেশে এটিই হবে আমাদের পেশা!
কৌতুহল থেকে শিশুরা অনলাইন গেম খেলা শুরু করে, একসময় নেশায় পরিণত হয়। আসক্ত শিশুরা নাওয়া-খাওয়া আর পড়াশুনা ভুলে মত্ত হয়ে থাকে গেমে। নেশায় ভাসতে থাকা শিশুরা পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি মানিয়ে নিতে পারে না। শিক্ষাক্ষেত্রে, পরিবারিক জীবনে, সামাজিক জীবনে দেখা দেয় নেতিবাচক প্রভাব। সকল পর্যায় থেকে হয়ে পড়ে বিচ্ছিন্ন।
পাবনা মানসিক হাসপাতালের মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা: মাসুদ রানা সরকার বলেন, মোবাইল গেম বহুবিধ মানসিক সমস্যা সৃষ্টির অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। প্রায় এসব শিশুরা চিকিৎসা নিতে আসে। এই নেশার জগতে যাতে শিশুরা জড়িয়ে না পড়ে সেজন্যে অভিভাবকদের তৎপর থাকতে হবে, চোখে চোখে রাখতে হবে, তাদেরকে সময় দিতে হবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. আনোয়ারুল হক সুফী।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের চক্ষু বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আব্দুল খালেক বলেন, একভাবে মোবাইল ফোন কিংবা কম্পিউটারের স্কিনে তাকিয়ে গেম খেলতে খেলতে শিশুদের চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। চোখের ফ্লুইড কমে যাচ্ছে, কর্ণিয়ার সমস্যা দেখা দিচ্ছে, দৃষ্টিশক্তি কমছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. আব্দুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, শিশুদের অনলাইন গেমের আসক্তি তাদেরকে পড়াশুনা বিমুখ করে তুলছে, তাদের মেধা বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে এ ব্যাপারে কার্যকরি পদক্ষেপ এখনই না গ্রহণ করলে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবো।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, কিছু সফটওয়ার আছে যেগুলো বয়সভেদে বিভিন্ন ডিভাইসের অনলাইন গেম বা যে কোনো প্রোগ্রাম ব্লক করতে পারে। এ ব্যাপারে আমাদের মন্ত্রণালয় অভিভাবকদের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। অভিভাবকদের উচিৎ তাদের শিশুদের ব্যবহার করা ডিভাইসে এসব সফটওয়ার ব্যবহার করা। অনলাইন গেমের আসক্তি থেকে আমাদের দেশের শিশুদের রক্ষা করতেই হবে।