নানা নাটকীয়তায় ঘেরা ছিল জাতীয় পার্টির নির্বাচন যাত্রা। শুরুতে নির্বাচনে যাওয়া, না যাওয়া। এরপর চলে সমঝোতা নিয়ে নাটকীয়তা। আওয়ামী লীগ থেকে ২৬টি আসনে ছাড় মিলে। এসব আসনে ছিল না নৌকার প্রার্থী। এসব আসনে স্বতন্ত্র বা নাম সর্বস্ব দলের প্রার্থীরা ছিলেন। এই ২৬ আসনের ১৫টিতেই হেরেছেন জাতীয় পার্টির প্রার্র্থীরা। ভোটের পর এবার নতুন দেন-দরবারে নেমেছে দলটি। সম্ভাব্য মন্ত্রিসভায় স্থান পেতে, বিরোধী দলের অবস্থান পেতে দলটি আওয়ামী লীগের সঙ্গে দেন-দরবার চালাচ্ছে। এর অংশ হিসেবে গতকাল সকালে দলটির নির্বাচিতরা আজ শপথ নেবেন না বলে জানানো হয়।
বিকালে অবশ্য সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হয় তারা শপথ নিচ্ছেন। এ বিষয়ে দলীয় সিদ্ধান্ত নিতে ডাকা সভাও বাতিল করা হয়।
ওদিকে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে হতাশা। তারা নির্বাচন ও জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতাদের ওপর প্রকাশ করছেন ক্ষোভ। তারা বলছেন, সমঝোতা না করে নির্বাচন করলে এর থেকে বেশি আসন মিলতো। দলের শীর্ষ নেতারা নিজেদের আসন রক্ষা করতে গিয়ে শেষ করে দিয়েছেন দলটাকেই।
কুড়িগ্রাম-১ আসন থেকে নির্বাচিত মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমরা যে ধরনের ভোটের পরিবেশ চেয়েছিলাম তা পাইনি। যার কারণে আমাদের অনেক সদস্য ভোটের মাঠে লড়াই করতে পারেননি। জয় পাননি।
নির্বাচন থেকে পূর্বেই সরে দাঁড়িয়েছিলেন জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশিদ। ঢাকা-৪ আসনের এই সংসদ সদস্য বলেন, জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ, ভবিষ্যৎ-ই বলে দেবে। তবে আমি এটুকুই বলবো জাতীয় পার্টির বিপর্যয় ঘটে গেছে। দলের এই অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ানো খুবই কঠিন।
গত রোববার হয়ে যাওয়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১১টি আসন পায় জাতীয় পার্টি। সমঝোতা হওয়া ২৬ আসনের মধ্যে ১৫ জন পরাজিত হন। জয় পাওয়া ১১ জন হলেন- জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের (রংপুর-৩), মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু (কিশোরগঞ্জ-৩), দলটির সাবেক মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার (পটুয়াখালী-১), কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ (চট্টগ্রাম-৫), প্রেসিডিয়াম সদস্য অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী (ফেনী-৩), মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান (সাতক্ষীরা-২), গোলাম কিবরিয়া টিপু (বরিশাল-৩), হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদ (ঠাকুরগাঁও-৩), এ কে এম মোস্তাফিজুর রহমান (কুড়িগ্রাম-১), শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ (বগুড়া-২) ও এ কে এম সেলিম ওসমান (নারায়ণগঞ্জ-৫)।
আবার দলীয় সূত্রে জানা যায়, ঢাকা-১৮ আসনের পরাজিত জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের স্ত্রী ও কো-চেয়ারম্যান শেরীফা কাদেরকে সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য করা হতে পারে। এ ছাড়া মন্ত্রিসভায় প্রতিনিধিত্ব চান দলটির শীর্ষ নেতারা। জিএম কাদেরের ঘনিষ্ঠ এক নেতা বলেন, আমাদের চেয়ারম্যান দলের ভিত্তি শূন্যে নামিয়ে এনেছেন। তিনি এখন তার স্ত্রীকে সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য বানাতে চান। এ ছাড়াও মন্ত্রিসভায় প্রতিনিধিত্ব চান। দলের কে কী ভাবলো, দলের কী হলো না হলো এ নিয়ে চিন্তা নাই তার।
সমঝোতার আসন পেয়েও পরাজিত হওয়া এক প্রার্থী বলেন, আমাদের দলের শীর্ষ নেতারা নিজেদের বিক্রি করে দিয়েছেন। তারা দলের ইমেজ বিক্রি করে দিয়েছে। সমঝোতার কথা বলে এমন একটা ইমেজ তৈরি করেছে যে ভোটারদের কাছে ভোট চাওয়াও যায় নাই। আমাদের দল আগে থেকেই গৃহপালিত ছিল এখন আর দলের কিছুই নেই।
তিনি মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নুর সমালোচনা করে বলেন, অযোগ্য লোক হয়ে কীভাবে তিনি মহাসচিব হন। তিনি বলে আসছেন সুষ্ঠু নির্বাচন চান, প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১৫০’র বেশি আসন আশা করেন। তিনিই প্রথম পোস্টারে লিখলেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত।
জাতীয় ছাত্র সমাজের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল মামুন বলেন, জাতীয় পার্টি একটি নির্বাচনমুখী দল। সুষ্ঠু ভোটের আশ্বাসে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও, জনগণ আওয়ামী লীগকে বিশ্বাস করতে পারেনি।
নীলফামারী-১ আসন থেকে লাঙ্গল নিয়ে নির্বাচন করা ইঞ্জিনিয়ার তসলিম উদ্দিন মুন্সী বলেন, খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের ৭ই জানুয়ারির নির্বাচনে আগ্রহ বা অনাগ্রহ কোনোটাই ছিল না। তাদের মাথায় এখন একটাই চিন্তা বাজারে চাল, ডাল, তেলসহ ভোগ্যপণ্যের দাম কবে কমবে? তাদের চিন্তা এই দুর্মূল্যের বাজারে কীভাবে বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তানদের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করবে।
শেষ সময়ে হবিগঞ্জ-২ থেকে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করা শংকর পাল বলেন, আমার জীবনে এত বাজে নির্বাচন দেখি নাই। যেভাবে সিল মারা হয়েছে এটা কিসের নির্বাচন? জাতীয় পার্টির ভরাডুবি তো হবারই ছিল। এখানে ২৬ আসন দেয়া হয়েছে এটা তো জাতীয় পার্টি ঠিক করে নাই, আওয়ামী লীগ ঠিক করেছে। যারা ফেল করবে তাদেরকেই দেয়া হয়েছে। এটা শুধুমাত্র সরকারকে সহযোগিতা করা হলো।
তিনি বলেন, আমাদের শীর্ষ নেতাদের তো ভোটের মাঠে লড়াই করে জেতার সক্ষমতা নাই।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা প্রকৌশলী ইকবাল হোসেন তাপস বলেন, জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে যারা আছেন তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন নাই। দুই/একজন নেতা লোভের বশবর্তী হয়ে দলটাকে একেবারে ধ্বংসের শেষ পর্যায়ে নিয়ে গেল। সরকার যেভাবে পরিকল্পনা করেছে সেভাবেই করেছে।
তিনি আরও বলেন, আমার মনে হয় জাতীয় পার্টি এখন ধ্বংসের শেষ প্রান্তে। শেষ বলে তো কিছু নাই। আমার মনে হচ্ছে জাতীয় পার্টি এখন ঘুরে দাঁড়ানোর যে নেতৃত্ব দরকার সেই নেতৃত্ব সংকটে ভুগবে।