এমটিএফই-এর প্রতারণার ফাঁদের রেশ কাটতে না কাটতেই ইউএস অ্যাগ্রিমেন্ট নামের আরেক অ্যাপের প্রতারণার ফাঁদে নিঃস্ব হয়েছেন অনেকে। অ্যাপটি ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এ ঘটনায় থানায় মামলা হলেও পুলিশ প্রতারককে গ্রেফতার করতে পারেনি।
নিজের ব্যবসার পুঁজির ৩০ লাখের সবই দিয়েছেন আরিফ হাসান বশির। ধার করে দিয়েছেন আরও ৩০ লাখ। কথা ছিল, মাসে প্রতি ১ লাখ টাকার জন্য ১১ হাজার ২০০ টাকা করে লভাংশ পাবেন আরিফ। চাইলে যে কোনো সময় বিনিয়োগ করা সব টাকা তুলেও নিতে পারবেন। এখন আরিফ লাভের টাকা তো দূরের কথা বিনিয়োগ করা টাকাও ফেরত পাচ্ছেন না। প্রতারিত হয়েছেন ‘ইউএস অ্যাগ্রিমেন্ট’ নামের এক অ্যাপের ফাঁদে পড়ে। রাজশাহী নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী আরিফ একা নন, তার মতো সারা দেশের প্রায় ২ হাজার মানুষ সর্বশান্ত হয়েছেন বিনিয়োগ করে। আরিফ জানান, ইউএস অ্যাগ্রিমেন্টে তিনি ২০২০ সালে বিনিয়োগ করেন। প্রথমে বিনিয়োগ করেন ৫ লাখ টাকা। ছয়-সাত মাস এই টাকার লভ্যাংশ পান। তা দেখে আরও প্রায় ৫৫ লাখ টাকা তুলে দেন জেলা এজেন্ট মিঠুনের হাতে। কিন্তু পরের এই টাকার কোনো লভ্যাংশ পাননি। আসল টাকাও ফেরত পাননি। ভুক্তভোগীরা বলেছেন, এর আগে এমটিএফই, ই-মুভি প্ল্যানসহ কয়েকটি বিদেশি অ্যাপ দেশে গ্রাহক তৈরি করে এভাবে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এসব অ্যাপ ছিল বিদেশি। তবে ইউএস অ্যাগ্রিমেন্ট ছিল দেশীয় প্রতারক চক্রের একটি অ্যাপ। অ্যাপের সার্ভার পরিচালনা হতো মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল থেকে। ইউএস অ্যাগ্রিমেন্টের প্রতারণার ঘটনায় মোস্তাক হোসেন (৪৫) নামের এক ব্যক্তি গত ১৭ জানুয়ারি রাজশাহী নগরীর রাজপাড়া থানায় মামলা করেন। তার বাড়ি নগরীর বহরমপুর এলাকায়। মামলায় পাঁচজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তারা হলেন- ইউএস অ্যাগ্রিমেন্টের রাজশাহী বিভাগীয় প্রধান ওয়াহেদুজ্জামান সোহাগ (৩৮), বিভাগীয় ব্যবস্থাপক ফাতেমা তুজ জহুরা মিলি (৩২), কান্ট্রি লিডার মোতালেব হোসেন ভূঁইয়া (৩৫), কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারুক হোসাইন সুজন (৩৯) এবং রাজশাহী জেলা এজেন্ট মিঠুন মন্ডল (৩৬)। এদের মধ্যে ওয়াহেদুজ্জামান সোহাগ ও ফাতেমা তুজ জহুরা মিলি স্বামী-স্ত্রী। তাদের বাড়ি রাজশাহী নগরীর নওদাপাড়ায়। কান্ট্রি লিডার মোতালেব লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ, কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারুক মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল এবং রাজশাহী জেলা এজেন্ট মিঠুন নগরীর বোয়ালিয়াপাড়ার বাসিন্দা। মামলা হওয়ার পর রাজশাহীর ৫৮ জন প্রতারিত ব্যক্তির নামের তালিকা পেয়েছে পুলিশ। মামলার বাদী মোস্তাক হোসেন খুইয়েছেন ৫ লাখ টাকা। তিনি বলেন, ‘অ্যাপের মূলহোতা সোহাগ আমাকে ব্যাংকের কাগজপত্র দেখান যে, বিনিয়োগ করলে রেমিট্যান্স হিসেবে ডলার আসে। আসলে এগুলো সবই সাজানো।
যে গ্রাহক রেমিট্যান্স পেয়েছেন তা ওই প্রতারক চক্রের সদস্যদেরই পাঠানো। প্রথমে বলা হয়েছিল, বিনিয়োগের টাকা যে কোনো সময় তোলা যাবে। আমি টাকা তুলে নিতে সোহাগের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি আমাকে হুমকি দেন যে, এগুলো নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে ভালো হবে না। তাই প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে আমি মামলা করেছি। ভুক্তভোগীরা জানান, সোহাগ ও মিঠুন নিজেই নগদ টাকা নিতেন। এরপর গ্রাহকের মোবাইলে একটি অ্যাপ ইনস্টল করে দিতেন। গ্রাহকের আস্থা অর্জনে তারা তাদের ব্যাংক হিসাবে বিদেশি সহযোগীদের মাধ্যমে ডলার পাঠিয়ে দিতেন। বলতেন, এটি বিনিয়োগের রেমিট্যান্স এসেছে। এভাবে বিশ্বাস অর্জন করে তারা টাকা লুটে নিয়েছেন। ইউএস অ্যাগ্রিমেন্টের রাজশাহী বিভাগীয় ব্যবস্থাপক ফাতেমা তুজ জহুরা মিলি বলেন, ‘আমি এই অ্যাপ সম্পর্কে আগে জানতাম না। পরে জেনেছি। আমি নিজে এসবের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম না। আমার স্বামী এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি এখন ভারতে। তার জন্য ঘরের বউকে হয়রানি করা ঠিক না। নগরীর রাজপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল হক বলেন, প্রতারিতরা আমাদের জানিয়েছেন যে, বিদেশি নাম দেওয়া হলেও এই অ্যাপটি দেশ থেকেই পরিচালনা করা হতো। ১ লাখ বিনিয়োগে মাসে ১১ হাজার ২০০ টাকা লাভ দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে এতে বিনিয়োগ করানো হয়। দু-এক মাস টাকা দিয়ে আর কাউকে টাকা দেওয়া হয়নি। মামলাটা কেবল হয়েছে। জড়িতদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।