সর্বশেষ
Home » শিক্ষা » পাঠ্য বইয়ের আরও যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা

পাঠ্য বইয়ের আরও যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা

শরীফার গল্প নিয়ে দেশজুড়ে বইছে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়। এরইমধ্যে সরকারের বিনামূল্যে দেয়া পাঠ্য বইয়ের আরও বেশ কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে অনেকেই নানা নেতিবাচক কথা বলে আসছেন। ভুলের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষাক্রম বোর্ড (এনসিটিবি) বলছে, মূল্যায়নপূর্বক সংশোধনীসমূহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠানো হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করেছে। সম্প্রতি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক আসিফ মাহতাব উৎস সপ্তম শ্রেণির শরীফা গল্প বইয়ের পাতা ছিঁড়ে আলোচনায় আসেন। এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ায় চাকরিও খোয়ান তিনি। তবে শরীফার গল্পের পাশাপাশি নতুন করে আলোচনায় এসেছে নকলের বিষয়টি। নবম শ্রেণির ‘বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়ে লেখা কপি করার অভিযোগ উঠেছে। ভারতের কোচিং সেবা দেয়া প্রতিষ্ঠান বাইজুসের ওয়েবসাইট থেকে লেখাটি কপি করা হয়েছে বলে জানা যায়।
লেখার হুবহু অনুবাদ ও কাছাকাছি ধরনের ছবি বইয়ে তুলে দেয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোসায়েন্স বিভাগের গবেষক নাদিম মাহমুদ এক নিবন্ধে বিষয়টি সামনে এনেছেন। বইয়ের ১২ নম্বর বাস্তুতন্ত্র অধ্যায়ের ১২.৭ অনুচ্ছেদে লেখাটি রয়েছে। নাইট্রোজেন চক্র শিরোনামে লেখাটিতে বলা হয়েছে, ‘নাইট্রোজেন চক্র (চিত্র ১২.১৬) পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নাইট্রোজেন জীবের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি, কিন্তু বায়ুমণ্ডলে এটি বিপুল পরিমাণে থাকলেও কোনো প্রাণী বা উদ্ভিদ এটি সরাসরি ব্যবহার করতে পারে না। নাইট্রোজেন চক্র এমন একটি জৈব ভূ-রাসায়নিক প্রক্রিয়া যেটি প্রায় নিষ্ক্রিয় নাইট্রোজেন গ্যাসকে জীবের ব্যবহারের উপযোগী করে রূপান্তরিত করে তুলে। এই চক্রের মাধ্যমে নাইট্রোজেন গ্যাস বায়ুমণ্ডল থেকে মাটিতে আসে এবং চক্র শেষে আবার বায়ুমণ্ডলে ফিরে যায়। এ লেখার সাদৃশ্য পাওয়া গেছে বাইজুসের ওয়েবসাইটে গিয়ে। সেখানে Nitrogen Cycle Definition শিরোনামে লেখা আছে, Nitrogen is a key nutrient element for plants. However, the abundant nitrogen in the atmosphere cannot be used directly by plants or animals. Read on to explore how the Nitrogen cycle makes usable nitrogen available to plants and other living organisms. Nitrogen Cycle is a biogeochemical process through which nitrogen is converted into many forms, consecutively passing from the atmosphere to the soil to organism and back into the atmosphere.
বিশিষ্ট ইসলামি ব্যক্তিত্ব শায়খ আহমাদুল্লাহ সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিনামূল্যে বিতরণ করা পাঠ্য বইয়ের ১০টি অসঙ্গতি তুলে ধরেন। শায়খ আহমাদুল্লাহ তার ভিডিওতে বলেন, শরীফার গল্প নিয়ে যখন আলোচনা হচ্ছে তখন আমরা বিভিন্ন বই নিয়ে পর্যালোচনা করেছি। তাতে আমরা দেখেছি নানা ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে। সুপরিকল্পিতভাবে মনমানসিকতা ধ্বংসকরণের কাজ চলছে। কোনো একটা মহল শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের কাজ করছে। তারা সরকারকে প্রভাবিত করছে। শরীফার গল্প গত বছর ছিল একই রকম। এবছর শুধু ট্রান্সজেন্ডার শব্দের জায়গায় হিজড়া লেখা হয়েছে। তার মানে যারা বই তুলে দিচ্ছেন তারা হিজড়া এবং ট্রান্সজেন্ডারের পার্থক্য না জানলে বিষয়টি আরও ভয়াবহ। ট্রান্সজেন্ডার হচ্ছে মানসিক সমস্যা। আর হিজড়া হচ্ছে শারীরিক সমস্যা। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের নিয়ে তো কেউ কথা বলছেন না। তাদের অধিকার সংরক্ষণ করে রেখেছে। ১৪ বছর বয়সে কেউ বিবাহ করলে বাধা দিচ্ছেন। বলছেন সে শিশু, বাল্যবিবাহ। কিন্তু শিশুকে লিঙ্গ পরিবর্তনের কথা শেখাচ্ছেন। সেক্ষেত্রে এই শিশু কী একেবারে লায়েক হয়ে গেল? তিনি আরও বলেন, আলিয়া মাদ্রাসার ইবতেদায়ি ইংরেজি প্রথম শ্রেণির বইয়ে ২০২২ সাল পর্যন্ত সালাম ছিল। ২০২৩ এবং ২০২৪ সালে সালাম তুলে গুড মর্নিং লেখা হয়েছে। এদেশের মানুষের সংস্কৃতি সালামের নাকি গুড মর্নিংয়ের? ইংরেজি বইয়ে গুড মর্নিং থাকতেই পারে। কিন্তু সালাম কেন বাদ দিলেন? তিনি প্রশ্ন রাখেন যদি সালাম ইংরেজিতে গুড মর্নিং হয়ে যায় তবে কী পহেলা বৈশাখকে পরিবর্তন করে দেবেন? একই বইয়ে মাদ্রাসার বই যেহেতু সেহেতু শিক্ষিকার মাথায় হিজাব ও শিক্ষার্থীদের মাথায় টুপি ছিল। এবছর বাদ দেয়া হয়েছে। ২০২৪ সালের সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে নাম পরিচয়, পছন্দের খাবার, খেলা, পোশাক ইত্যাদি আছে। কিন্তু ধর্মের পরিচয় নেই। ধর্ম কী তার পরিচয় নয়? মাদ্রাসার বইয়ের কভারে বিভিন্ন স্থানে হারমনি, ঢোল, তবলা, নাচ শেখানো হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে এগুলো ইসলামে জায়েজ আছে কিনা? মাদ্রাসায় ইসলামের মূল্যবোধ আছে বলেই মাদ্রাসায় পড়ে। এগুলো দিয়ে রীতিমতো আপনি টর্চার করছেন। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বইয়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ের অন্যতম উদ্দেশ্যই যেন বন্ধুত্বের নামে ছেলেমেয়ের অবৈধ সম্পর্কে উদ্বুদ্ধকরণ। সেখানে চল বন্ধু হই পাঠে বলা হয়েছে, প্রয়োজনে না বলি, যা চাই তা বলি, অনুভূতি প্রকাশ করি। কী বোঝাতে চাওয়া হয়েছে তা মনে হয় বলার প্রয়োজন নেই। ষষ্ঠ শ্রেণির স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ে ছেলেমেয়ের হাত ধরে চলাফেরা-ঘুরাফেরা করাকে নিরাপদ স্পর্শ বলা হয়েছে। আমাদের সমাজে কিশোর বয়সে নানা ধরনের হ্যারেজমেন্ট হয়। ছেলে মেয়ের স্বাভাবিক স্পর্শকে স্বাভাবিক হিসেবে ধরা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, সপ্তম শ্রেণির স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ে অতুল এবং নিরা, অন্তর এবং ফাহিমা এই গল্পগুলোতে রীতিমতো বলা হয়েছে অবৈধ সম্পর্কে গেলে কোনো অভিভাবকের শাসন করা উচিত নয়। বোঝানো হচ্ছে তারা একে অপরকে পছন্দ করে, একে অপরের সঙ্গে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক করে তারা পড়ালেখা চালাতে পারে। অভিভাবকদের সেখানে ইন্টারফেয়ার করা উচিত নয়। অভিভাবকের শাসনকে নেতিবাচক হিসেবে বলা হয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণির শিল্প ও সংস্কৃতি বইয়ে বৈশাখ পালন করাকে বলা হচ্ছে সংস্কৃতির অমূল্য অংশ। পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপন গত ৩০/৩৫ বছর আগে শুরু হয়েছে। অনেকেই এই ঘটনার শুরুর সাক্ষী। পাশাপাশি গায়ে হলুদ, জন্মদিন পালন আমাদের দেশের সংস্কৃতি। এগুলোর সঙ্গে আমাদের কী সম্পর্ক আছে? নবম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে ভারতের স্বাধীনতায় মুসলমানদের অবদান একেবারে উল্লেখ করা হয়নি। ভারতের ইন্ডিয়া গেটে পর্যন্ত মুসলমানদের নাম উল্লেখ আছে। যারা স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছেন। অর্থাৎ এখানে শেখানো হচ্ছে মুসলমানদের ভারতের বিজয় আন্দোলনে কোনো অবদান নেই। ভারতের সমৃদ্ধির জন্য ইংরেজদের অবদানের কথাও বলা আছে। কিন্তু যেখানে মুসলমানদের অবদান অনেক উঁচুতে আছে। সেগুলো বইতে কিছু নেই। নবম শ্রেণির ইসলাম শিক্ষা বইয়ে জিহাদ তুলে দেয়া হয়েছে। আবার একই ক্লাসের ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে বলা হয়েছে- সবার উপর মানুষ সত্য তাহার উপর নাই। প্রশ্ন হচ্ছে আমার পরিচয় কোনটাকে বড় করবো সেটা কী আপনার বিষয়। এটা ধর্ম বিমুখ করার কারণটা কী? কোরআন হাদীস যখন সে পড়বে তখন জিহাদ পড়বে না? তবে জিহাদের নামে সন্ত্রাস, বিশৃঙ্খলা করে সেটার সমালোচনা হতে পারে। নবম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে ফিলিস্তিনের নাম নাই। সেখানে ইসরাইলকে বড় করে দেখানো হয়েছে।

তিনি ভুল তুলে ধরার পর বলেন, এরকম আরও অনেক বিষয় আছে। যেমন, সেক্স এডুকেশনের বাচ্চাদের লাজুকতা ধ্বংস করছে। বেহায়াপনা, অবৈধ সম্পর্কের দিকে ধাবিত করা হচ্ছে এজন্য কারা এগুলো করেছে? কেন করেছে এটি খুঁজে বের করতে হবে। এদিকে গতকাল পাঠ্যপুস্তকের সংশোধনী বিষয়ে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয় জাতীয় পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষাক্রম বোর্ড (এনসিটিবি)। তারা গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে পাঠ্যপুস্তক যৌক্তিকভাবে মূল্যায়নপূর্বক সংশোধনীসমূহ অতিদ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমে প্রেরণ করা হবে বলে জানানো হয়। এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সম্মানিত শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষার্থী, শিক্ষানুরাগী, সকলের সদয় অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক প্রণীত ২০২৪ সালের বইয়ের বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা ও গভীর পর্যবেক্ষণে যে সকল বিষয় উঠে এসেছে তা আমরা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছি। উল্লেখ্য যে, বছরের প্রথম দিনে পাঠ্যপুস্তক বিতরণের সময় আমরা সকল শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে পাঠ্যপুস্তক সম্পর্কে কোনো পরামর্শ থাকলে তা অবহিতকরণের সনির্বন্ধ অনুরোধ জ্ঞাপন করেছিলাম। আপনারা আমাদের সে আহ্বানে তাৎপর্যপূর্ণ ইতিবাচক মতামত দিয়েছেন। এতে আরও বলা হয়, আপনাদের এই তাৎপর্যপূর্ণ মতামত আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করে আমাদের বিদ্যমান পাঠ্যপুস্তক যৌক্তিকভাবে মূল্যায়নপূর্বক সংশোধনীসমূহ অতিদ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমে প্রেরণ করা হবে। যারা আমাদের নানা তথ্য, উপাত্ত, যৌক্তিক বিশ্লেষণ এবং সঠিক উপস্থাপনার মাধ্যমে পাঠ্যপুস্তকের মানোন্নয়নে সহায়তা করছেন, তাদের প্রতি অশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *