দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা চুয়াডাঙ্গার দর্শনা সীমান্ত থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে ৪ নারী চোরাকারবারিকে হঠাৎ ঘিরে ধরেন কয়েক পুলিশ কর্মকর্তা। সবাই সাদা পোশাকে। একটু আলো থাকায় তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় পাশেই থাকা কিছুটা অন্ধকার গলিতে। সেখানে পুলিশ কর্মকর্তারা ৪ নারীকে তল্লাশি শুরু করেন। সঙ্গে নানা ধরনের হুমকি ও ধমকি। ৪ নারীর কাছে তারা খোঁজ করছিলেন প্রতিবেশী দেশ থেকে আনা চোরাই স্বর্ণের বার। কিন্তু নারীরা অনড়। প্রথমদিকে তারা বিষয়টি অস্বীকার করেন। একপর্যায়ে পুলিশ কর্মকর্তারা জোর করে নারীদের স্পর্শকাতর স্থানগুলোতে হাত দেন। তখন বাধ্য হয়ে তাদের কাছে থাকা ২৪ পিস স্বর্ণের বার বের করে দেন পুলিশের হাতে।
তখন ওই নারীরা বলেন, স্বর্ণের বারসহ থানায় নিয়ে যেতে। কিন্তু পুলিশ কর্মকর্তারা তাদেরকে থানায় নিয়ে যেতে অস্বীকৃতি জানান। উল্টো ক্রসফায়ার ও নারী পাচারকারি হিসেবে চিহ্নিত করে মামলার ভয় দেখান। এতে ভীত হয়ে ৪ নারী দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। সরে পড়েন পুলিশ কর্মকর্তারাও। মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে এভাবেই চোরাই ২৪টি স্বর্ণের বার ছিনতাই করে নেন পুলিশ কর্মকর্তারা। যার আনুমানিক মূল্য প্রায় আড়াই কোটি টাকা। ঘটনাটি ২০২৩ সালের জুন মাসে। স্পট দর্শনার রেলস্টেশন সংলগ্ন সংগ্রামের বাড়ির গলিতে। ওই ঘটনার সঙ্গে অভিযুক্ত করা হয়েছে চুয়াডাঙ্গা জেলা গোয়েন্দা শাখায় কর্মরত এসআই বাশার, এসআই মুহিত, এএসআই বিজন, এএসআই রাজিবুল, এএসআই আবেদুর, কনস্টেবল সাদ, কনস্টেবল নয়ন ও কনস্টেবল সাকিবকে।
মানবজমিনের কাছে ঘটনার বর্ননা দিয়ে ৪ নারীর মধ্যে পাখি নামের এক নারী জানান, আমরা সন্ধ্যার দিকে বেনাপোলে ট্রেন থেকে লাফ দেই। সঙ্গে সঙ্গে ৫ জন পুলিশ আমাদের ঘিরে ধরে। আমরা সবাই বাড়ির গৃহবধূ। টানাটানির সংসারের জন্য মাঝে মাঝে চোরাই মাল আনা নেয়া করি। এতে কিছু টাকা পাই। সংসার চলে। সাদা পোশাকে থাকা পুলিশরা আমাদের ৪ মহিলাকে ব্যাপক হেনস্তা করে। তারা শরীরের বিভিন্ন জায়গায় হাত দেয়, বুকে হাত দেয়। তাদের সঙ্গে কোনো মহিলা পুলিশ ছিলেন না। ওই ঘটনার পর তিনি এলাকা ছেড়েছেন বলে জানান। পাখি বলেন, এত টাকার মাল পুলিশ নিমিষেই আমাদের কাছ থেকে নিয়ে যায়। আমরা চুরি করি আর আমাদের কাছ থেকে পুলিশ ডাকাতি করে নিয়ে যায়। আমাদের মেরে ফেলার হুমকি দেয়া হয়েছে। তাই ভয়ে এলাকা ছেড়ে ঢাকার নিউমার্কেট এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছি। গার্মেন্টসে চাকরি নিয়েছি। শুনেছি ওই পুলিশরা এখনো চুয়াডাঙ্গায় কাজ করছেন। তারা যতদিন চুয়াডাঙ্গায় থাকবেন ততদিন আমি এলাকায় যাবো না। কারণ তারা ভয়ঙ্কর। এরপরই মানবজমিনের পক্ষ থেকে ওই ঘটনায় অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তা এসআই বাশার, এসআই মুহিত, এএসআই বিজন, এএসআই রাজিবুলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তারা প্রত্যেকেই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেন।
পাশাপাশি এ ধরনের ঘটনা নিয়ে নিউজ না করার পরামর্শ দেন। পরে তাদের মধ্য থেকে দুজন পুলিশ কর্মকর্তা নানা মাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ না করার অনুরোধ জানান প্রতিবেদককে। এদিকে নাম প্রকাশ না করে বিষয়টি নিয়ে তদন্তের দাবি জানিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে সম্প্রতি চিঠি দেয়া হয়েছে। একই চিঠি দেয়া হয়েছে চুয়াডাঙ্গা পুলিশ সুপারকেও। তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চুয়াডাঙ্গা পুলিশ সুপার এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেননি। অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তারা গোয়েন্দা বিভাগের ওসি ফেরদৌস ওয়াহিদের অধীনে কাজ করছেন। এ প্রসঙ্গে ওই ওসি মানবজমিনকে জানান, ঘটনাটি গত বছরের জুন মাসের হলে আমি তখন দায়িত্বে ছিলাম না। আমি পরে ওসি ডিবি হিসেবে যোগদান করি। তবে তাদের মধ্যে একজনকে নারীঘটিত বিষয়ের কারণে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে রাখা হয়েছে বলে জানান। অন্যদের বিষয়ে বড় ধরনের কোনো অভিযোগের বিষয়ে জানা নেই বলে দাবি করেন ফেরদৌস ওয়াহিদ। পুলিশ সদর দপ্তর ও পুলিশ সুপারের কাছে দেয়া লিখিত অভিযোগে ওই পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আরও ৯টি স্বর্ণের বার ছিনতাইসহ আরও বেশকিছু অভিযোগ উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে চুয়াডাঙ্গার পুলিশ সুপার এসএম ফয়জুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, তিন মাস আগে এ জেলায় দায়িত্বে এসেছি।
এর মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। প্রতিদিন অনেক ধরনের চিঠি আসে। তবে এ ধরনের কোনো অভিযোগ আপাতত আমার নজরে আসেনি। তবে শিগগিরই বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। চুয়াডাঙ্গা পুলিশ সুপার বরাবর দেয়া লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে-আপনার বিশেষ অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, আপনার অধীনস্ত জেলা গোয়েন্দা শাখা, চুয়াডাঙ্গায় কর্মরত এসআই বাসার, এসআই মুহিত, এএসআই বিজন, এএসআই রাজিবুল, এএসআই আবেদুর, কনস্টেবল সাদ, কনস্টেবল নয়ন, কনস্টেবল সাকিব গংয়ের অপকর্ম যা আপনার জানা বিশেষ প্রয়োজন। দর্শনা রেলস্টেশন সংলগ্ন সংগ্রামের বাড়ির গলিতে ১। বিউটি বেগম, স্বামী- আলম, ২। তানিয়া, পিতা- হামিদ, ৩। কাজলী, পিতা/স্বামী-অজ্ঞাত, সর্ব সাং-দর্শনা (স্টেশনপাড়া), থানা- দর্শনা, জেলা- চুয়াডাঙ্গা, ৪। রশিদা, পিতা/স্বামী-অজ্ঞাত, সাং-দর্শনা (স্টেশনপাড়া), থানা- দর্শনা, জেলা-চুয়াডাঙ্গা,বর্তমান-নবীনগর, ঢাকাগণদের নিকট থেকে ২৪ পিস স্বর্ণের বার ছিনতাইপূর্বক কেড়ে নেয়।
উক্ত পুলিশ সদস্যগণ জনৈক মো. নজু, সাং-উথুলী, থানা-জীবননগর, জেলা-চুয়াডাঙ্গার নিকট থেকে ৪৫/৫০ পিস ফেনসিডিল উদ্ধার করে মামলা না দিয়ে ৩০,০০০/- টাকার বিনিময়ে তাকে ছেড়ে দেয়। উক্ত পুলিশ সদস্যগণ জনৈক মো. আজিজ, সাং-ডুমুরিয়া দেহাটি, থানা- জীবননগর, জেলা-চুয়াডাঙ্গা এর নিকট থেকে ৫০ পিস ফেনসিডিলসহ তাকে আটক করে। পরবর্তীতে ডুমুরিয়ার জনৈক আজিমের মাধ্যমে ১,০৮,০০০/- টাকার বিনিময়ে মামলা না দিয়ে তাকে ছেড়ে দেয়। উক্ত পুলিশ সদস্যগণ উথুলী মোড় থেকে একজন মোটরসাইকেল আরোহীর নিকট থেকে সকাল ৬.৩০ ঘটিকার সময় ৯ পিস স্বর্ণের বার জোরপূর্বক ছিনতাই করে কেড়ে নেয়। যাহা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কেউ উক্ত বিষয়ে জানেন না। এদিকে বিষয়টি নিয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টার সূত্র মানবজমিনকে জানিয়েছে, অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত চলছে। শিগগিরই এ নিয়ে প্রতিবেদন দেয়া হবে ও জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমুলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।