সর্বশেষ
Home » অন্যান্য » ভিকারুননিসা যেন এক অনিয়মের স্বর্গ স্বর্গরাজ্য

ভিকারুননিসা যেন এক অনিয়মের স্বর্গ স্বর্গরাজ্য

যৌন হয়রানির অভিযোগে উত্তাল রাজধানীর স্বনামধন্য ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ। ছাত্রীদের সঙ্গে বিরূপ আচরণের দায়ে মুরাদ হোসেন সরকার নামে এক শিক্ষককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এই ঘটনাই শুধু নয়, এর আগেও কুরুচিপূর্ণ মেসেজ দেয়ার দায়ে দায়িত্বচ্যুত করা হয়েছিল আরেক শিক্ষককে। ১৯৫২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটি। স্কুলটির মূল ক্যাম্পাস বেইলী রোডে। এ ছাড়া রাজধানীর ধানমণ্ডি, আজিমপুর ও বসুন্ধরায় চারটি শাখা রয়েছে। সব শাখা মিলিয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২৭ হাজার ও স্থায়ী-অস্থায়ী শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছেন প্রায় ৮৫০ জন।
গত ১৪ বছর ধরে নেই অধ্যক্ষ। এই এক যুগের বেশি সময় ধরে চলছে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দিয়ে। আগের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অধ্যাপক কামরুন নাহার মুকুলের বিরুদ্ধেও ছিল বিস্তর অভিযোগ। পরিচালনা পর্ষদের সদস্যের সঙ্গে ছড়িয়ে পড়া এক কল রেকর্ড ঘিরেও বেরিয়ে এসেছিল থলের বিড়াল।

এ ছাড়াও স্থায়ী ক্যাম্পাসের দাবিতেও আন্দোলন করেছেন শিক্ষার্থীরা। নিয়ম লঙ্ঘন করে ১৬২ জন শিক্ষার্থীকে ভর্তি করা হয়েছিল। গভর্নিং বডির সদস্যরা অধ্যক্ষের স্বাক্ষর ছাড়াই ভর্তি করিয়েছিলেন ৪৪৩ জন শিক্ষার্থীকে। গতকাল অনিয়ম অভিযোগে ডুবতে থাকা প্রতিষ্ঠানটির ১৬৯ জন শিক্ষার্থীর ভর্তি বাতিল করা হয়।
মুরাদ হোসেন সরকারের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির বিস্তর অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা। এই ঘটনায় আজিমপুর শাখার গণিতের ওই শিক্ষক দু’দিনের রিমান্ডে রয়েছেন। মুরাদ হোসেন সরকারের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ থাকলেও ফেব্রুয়ারিতে দেয়া প্রতিবেদনে তাকে সতর্ক করে ছেড়ে দেয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু আন্দোলন জোরালো হলে তাকে বহিষ্কার করে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এত বড় ঘটনা ঘটার পরও গভর্নিং বডির সদস্যদের নীরবতা প্রশ্ন তুলছে। এবিষয়ে জানতে চাইলে অভিভাবক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মজিদ বলেন, অভিভাবকরা আন্দোলনে নামার পরই তাকে অন্য শাখায় বদলির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী ও শিক্ষক প্রতিনিধি ড. ফারহানা খানম বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে কোচিংয়ের ফাঁকে শিক্ষার্থীকে অশালীন মেসেজ প্রেরণ করার দায়ে অভিযুক্ত ওই শিক্ষককে ক্লাস থেকে বরখাস্ত করা হয়। ২০২৩ সালে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ কামরুন নাহারকে ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) করা হয়। কামরুন নাহারের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহার ও ব্যাপক আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দেয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। ৬১ পৃষ্ঠার অভিযোগে ভিকারুননিসার অধ্যক্ষ কামরুন নাহার ও শিক্ষা প্রতিনিধি ড. ফারহানা খানমের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহার ও ব্যাপক আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এরমধ্যে ছিল ভর্তি বাণিজ্য, শিফট পরিবর্তন, নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ। এ ছাড়াও উগ্র ভাষায় গভর্নিং বডির এক সদস্যের সঙ্গে কথোপকথনও ছড়িয়ে পড়েছিল নেট দুনিয়ায়।

ভিকারুননিসায় অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করতে সরকারি কলেজের শিক্ষকদের মধ্য থেকে অধ্যক্ষ নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয়নি। কমিটির সভাপতি এবং অধ্যক্ষ দু’জনই সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বে থাকার পরও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিয়োগ নিয়ে কলেজটিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।
২০১৮ সালে প্রায় ১ এক হাজার ২০০ শিক্ষার্থী অতিরিক্ত ভর্তি করা হয়। ২০১৯ সালে অধ্যক্ষের স্বাক্ষর না নিয়ে ৪৪৩ জন শিক্ষার্থী অতিরিক্ত ভর্তি করায় গভর্নিং বডি। এই অভিযোগে একজন সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যান কমিটির সদস্যরা। অভিযোগ মতে একই বছর ১৬২ জন অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করায়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দাখিল করা আবেদনে বলা হয়, কেকা রায় চৌধুরী ১৬২ জন অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করান। কিন্তু ভর্তি ফরমে স্বাক্ষর না নিয়ে গভর্নিং বডি ৪৪৩ জন শিক্ষার্থীকে ভর্তি করায়। কিন্তু এর দায় চাপানো হয় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হাসিনা বেগমের ওপর। তিনি মাত্র ৭৫ দিন দায়িত্বে ছিলেন। ২০২০ সালে অতিরিক্ত ছাত্রী ভর্তির অভিযোগ ওঠে অধ্যাপক ফওজিয়ার বিরুদ্ধে।

২০১৯ সালে অবৈধভাবে স্থায়ী অধ্যক্ষ নিয়োগের চেষ্টা করা হলে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয় অধ্যক্ষ নিয়োগে স্থগিতাদেশ দেয়। ২০২১ সালের শেষে গঠন করা হয় প্রথম অ্যাডহক কমিটি। কিন্তু এই কমিটি ছয় মাসেও নির্বাচন আয়োজন করতে ব্যর্থ হয়। ছয় মাস মেয়াদ বাড়ানো হলেও নির্বাচন দিতে পারেনি অ্যাডহক কমিটি। অ্যাডহক কমিটি ২০২২ সালে নিয়োগ দেয় শাখা প্রধান এবং ৫০ জন শিক্ষক-কর্মচারী। আবার কমিটির বৈধতা না থাকাকালে ১৯ জন শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দেয়। অধ্যক্ষ নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল পাঁচ বছর আগে। কিন্তু ৪০ লাখ টাকা ঘুষ লেনদেনের অভিযোগে সেই প্রক্রিয়া ভেস্তে যায়। অভিযোগ রয়েছে, ২০১৯ ও ২০২০ সালে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের বিভিন্ন শ্রেণিতে ৭৫০ জন শিক্ষার্থী অবৈধভাবে ভর্তি করা হয়। শিক্ষার্থী প্রতি ভর্তির জন্য নেয়া হয় ৪-৫ লাখ টাকা। অনিয়ম রয়েছে শিক্ষার্থীদের শাখা বদলিতেও। শাখা বদলিতে নেয়া হয় ৫০ হাজার টাকা থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত। শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে হয় লাখ লাখ টাকার লেনদেন। এ ছাড়াও স্কুলের কেনাকাটা ও টেন্ডারেও রয়েছে দুর্নীতি।

নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগে গতকাল ১৬৯ জন শিক্ষার্থীর ভর্তি বাতিল করে সরকার। স্কুলটির প্রথম শ্রেণির এই শিক্ষার্থীদের সবাই চলতি বছরে ভর্তি হয়েছে। হাইকোর্টের একটি প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিক্ষা অধিদপ্তর। কলেজের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃক ২০২৪ শিক্ষাবর্ষে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির ঊর্ধ্বসীমা নির্ধারণ করে আবার তা অনুসরণ না করে ১লা জানুয়ারি ২০১৭ সালের পূর্বে জন্মগ্রহণকারী (প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রেরিত সংযুক্ত তালিকায় বর্ণিত) শিক্ষার্থীদের ভর্তি করাটা ছিল বিধিবহির্ভূত। এমতাবস্থায়, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ২০২৪ শিক্ষাবর্ষে প্রথম শ্রেণিতে বিধিবহির্ভূত ১লা জানুয়ারি ২০১৭ সালের পূর্বে জন্মগ্রহণকারী ভর্তিকৃত, প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রেরিত সংযুক্ত তালিকায় বর্ণিত ২০১৫ সালে জন্মগ্রহণকারী ১০ জন এবং ২০১৬ সালে জন্মগ্রহণকারী ১৫৯ জনসহ মোট ১৬৯ জন শিক্ষার্থীদের ভর্তি বাতিল করতে জরুরিভিত্তিতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরকে অবহিত করার জন্য অনুরোধ করা হলো।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বলেন, প্রতিষ্ঠানটিতে ব্যাপক পরিমাণ দলাদলি। আমরা ভিকারুননিসার ব্যাপারটি পর্যবেক্ষণ করছি। আমরা গভর্নিং বডি কী সিদ্ধান্ত নেয় সেটি পর্যবেক্ষণ করছি। এরপর আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরীর মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলে কোনো সাড়া মেলেনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *