প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ আমন্ত্রণে ঢাকায় তাৎপর্যপূর্ণ এক সফর করে গেলেন কাতারের আমীর শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি। বাংলাদেশে প্রায় ২২ ঘণ্টা কাটিয়েছেন তিনি। ওই সময়ে প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়েছে। দীর্ঘ মেয়াদে দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া অর্থাৎ বহুমাত্রিক যোগাযোগ আরও বিস্তৃত করার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আলোচনা হয়েছে। পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের ভাষ্য মতে, কাতারের ডেলিগেশনের অভিমত ছিল এমন যেন তারা এক নতুন এক বাংলাদেশ দেখছেন। ‘সিং ইজ বিলিভিং’ অর্থাৎ দেখায় বিশ্বাসের দরজা খুলে এমনটাই স্মরণ করা হচ্ছিলো বার বার। সচিব বলেন, বাংলাদেশের সম্ভাবনার বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হয়েছে আমীরের সামনে। আমীরও বদলে যাওয়া বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের নতুন নতুন এভিনিউ ওপেন করার বিষয়ে জোর দিয়েছেন। আরও বেশি দক্ষ জনশক্তি রপ্তানিতে আমীর জোর দিয়েছেন। বাংলাদেশের তরফে সেমি বা অদক্ষ শ্রমিকদের বিষয়টিও দেখভালের অনুরোধ করা হয়েছে।
পোর্ট ব্যবস্থাপনায় সম্পৃক্ত হতে আগ্রহের পাশাপাশি কক্সবাজারস্থ বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমুদ্র সৈকতকে ঘিরে সৃষ্ট ট্যুরিজমের অপার সম্ভাবনায় নিজেদের যুক্ত করতে চায় কাতার। যুদ্ধ-বিগ্রহসহ যেকোনো কারণে জ্বালানির বৈশ্বিক সংকট হলেও উদারভাবে বাংলাদেশের পাশে থাকার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে দোহা। আমীর বলেছেন, ২০১৭ সালের গালফ রিজিওনের অন্য দেশগুলোর অপছন্দ সত্ত্বেও বাংলাদেশ যেভাবে কাতারের পাশে দাঁড়িয়েছিল ঠিক সেভাবেই দোহা ঢাকার পাশে থাকার চেষ্টা করবে। ৩ দেশ সফরের অংশ হিসেবে আমীর সোমবার ৫টায় বাংলাদেশে এসেছিলেন। মঙ্গলবার বিকাল ৩টার দিকে তিনি নেপালের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছেড়ে যান। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভ্রাতৃপ্রতীম কাতারের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ককে আরও জোরদারের যেমন আশা ব্যক্ত করে গেছেন তিনি, তেমনি ব্যবসা ও বিনিয়োগ নিয়ে দু’দেশের মধ্যে ১০টি চুক্তি ও সমঝোতা সই হয়েছে তার উপস্থিতিতে। ঢাকা সফরের বিষয়ে মাইক্রোব্লগিং সাইট এক্সে এক পোস্টে শেখ তামিম বলেন, দুই দেশের বর্তমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক মজবুত করার জন্য বাংলাদেশ সফর এবং রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করতে পেরে আমি আনন্দিত। বৈঠকে আমরা দু’দেশের ফলপ্রসূ সহযোগিতার সব দিক এবং অন্য অনেক ক্ষেত্রে আরও দ্বিপক্ষীয় অংশীদারিত্বের মাধ্যমে এ সহযোগিতাকে ত্বরান্বিত করার সুযোগ নিয়ে আলোচনা করেছি। সফরের শেষ দিন মঙ্গলবার সকালে তেজগাঁওয়ের প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে শুরুতে একান্ত বৈঠক এবং পরে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও কাতারের আমীর শেখ তামিম। এরপর তাদের উপস্থিতিতে দু’দেশের মধ্যে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, বন্দর ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা এগিয়ে নেয়ার বিষয়ে পাঁচটি চুক্তি ও পাঁচটি সমঝোতা স্মারক সই হয়।
চুক্তি সই অনুষ্ঠানে ঘোষণা দেয়া হয়, মিরপুরের কালশীতে বালুর মাঠে নির্মিতব্য পার্ক ও মিরপুর ইসিবি চত্বর থেকে কালশী ফ্লাইওভার পর্যন্ত সড়কটি কাতারের আমীরের নামে নামকরণ করা হচ্ছে। পরে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে সৌজন্য বৈঠক করেন কাতারের রাষ্ট্রপ্রধান। এরপর রাষ্ট্রপতির আয়োজনে মধ্যাহ্নভোজে যোগ দেন তিনি। এ সময় বাংলাদেশের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে (এসইজেড) কাতারের বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের আহ্বান জানান রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন। রাষ্ট্রায়ত্ত বার্তা সংস্থা বাসস জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, মন্ত্রী পরিষদের সদস্য, উপদেষ্টা ও কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি এ ভোজে অংশ নেন। কাতারের আমীরের সম্মানে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়। ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান এবং কূটনৈতিক মধ্যস্থতার কারণে কাতার মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশ হিসেবে পরিচিত। আরবের এ দেশ বাংলাদেশের অন্যতম শ্রমবাজারও; যেখানে প্রায় ৪ লাখ বাংলাদেশি কাজ করছেন। তেল ও গ্যাস সমৃদ্ধ কাতার জ্বালানি আমদানির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উৎস। এসব কারণে কাতারের আমীর শেখ তামিমের এ সফরকে ‘বিনিয়োগের সম্ভাবনা’ হিসেবে আগে থেকেই দেখছিল সরকার। সফর শেষেও সরকারের প্রতিনিধিরা সম্ভাবনার কথাই বলছেন। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক অঞ্চল করতে কাতারের আমীরের কাছে প্রস্তাব রাখা হয়েছে বলে নিশ্চিত করা হয়েছে। বিষয়টি যে আলোচনায় উঠবে তা আগের দিনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ধারণা দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠনের পর মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশ থেকে এটিই প্রথম উচ্চপর্যায়ের রাষ্ট্রীয় সফর। তাছাড়া গত দুই দশকের মধ্যে কাতারের কোনো আমীরের এটিই ছিল প্রথম বাংলাদেশ সফর। সবশেষ ২০০৫ সালে (বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে) কাতারের তখনকার আমীর (বর্তমান আমীরের পিতা) হামাদ বিন খলিফা আল থানি সর্বশেষ বাংলাদেশ সফর করেছিলেন।