কমছে না তাপপ্রবাহ। তীব্র গরমে ওষ্ঠাগত জনজীবন। প্রতিনিয়তই অসুস্থ হচ্ছে মানুষ। শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে বয়োবৃদ্ধ- সবাই আক্রান্ত হচ্ছেন মৌসুমি রোগে। এক সপ্তাহ বন্ধ থাকার পর গতকাল চালু হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তবে প্রথম দিনের পরিস্থিতি সুখকর নয়। বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষার্থীদের অসুস্থ হয়ে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও কলেজছাত্র ও দুই শিক্ষকসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মৃত্যু হয়েছে ৭ জনের। যারা হিটস্ট্রোকে মারা গেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এদিকে তীব্র গরমের মধ্যে আবহাওয়া অধিদপ্তর দেশের বিভিন্ন এলাকার ওপর যে তাপমাত্রা বয়ে যাচ্ছে বলে জানাচ্ছে বাস্তবে তার থেকে বেশি অনুভূত হচ্ছে মানুষের শরীরে। তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে সেটি অনুভূত হচ্ছে ৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত।
গতকাল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল যশোর জেলায়। আর রাজধানীর তাপমাত্রা ছিল ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এমতাবস্থায় আরও তিনদিনের হিট এলার্ট জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। আর দাবদাহের কারণে ঢাকা, চুয়াডাঙ্গা, যশোর, খুলনা ও রাজশাহী জেলার সকল স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আজ বন্ধ থাকবে। তবে এসব জেলায় প্রাথমিক স্কুল খোলা থাকবে।
তীব্র গরমে যখন হাঁসফাঁস অবস্থা তখন গুগল সার্চ ইঞ্জিনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী কোনো এলাকায় বয়ে যাওয়া তাপমাত্রার চেয়েও বেশি অনুভূত হচ্ছে। সাধারণত আবহাওয়া অধিদপ্তর যে তাপমাত্রার তথ্য দিচ্ছে বাস্তবে তার চেয়ে ৬-৭ ডিগ্রি বেশি অনুভূত হচ্ছে। গতকাল বিকাল পৌনে ৫টার দিকে যখন রাজধানীর তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি তখন সেটি অনুভূত হচ্ছিল ৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মূলত জলীয় বাষ্পের আধিক্যের কারণে মানুষের শরীরে গরম বেশি অনুভূত হচ্ছে। ‘ফিলস লাইক’ বা অনুভূত তাপমাত্রা কেন বেশি হচ্ছে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ একেএম নাজমুল হক। মানবজমিনকে তিনি বলেন, মানুষের শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৯৮.৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট। সে হিসাবে আমাদের শরীরের ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি তাপমাত্রা সহনীয়। কিন্তু বেশি তাপমাত্রা বয়ে গেলে সেটি আর শরীর গ্রহণ করতে পারে না। তখন যে তাপমাত্রা থাকে তার চেয়ে বেশি আমাদের শরীরে অনুভূত হয়। তিনি বলেন, বাতাসে জলীয় বাষ্পের আধিক্যের কারণে আমাদের শরীরের তাপ বেশি অনুভূত হয়। বায়ুম-লের তাপ মানুষের শরীরে ঢুকে যায়। শরীরের যে পানি থাকে তা জলীয় বাষ্পের মাধ্যমে শোষণ হয়। জলীয় বাষ্প বেশি হলে বাতাসে তাপ আবদ্ধ হয়ে থাকে বেশি। তাই আমাদের কাছে বেশি গরম অনুভূত হয়।
এদিকে গতকাল আরও ৭২ ঘণ্টার হিট এলার্ট জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. হাফিজুর রহমান স্বাক্ষরিত তাপপ্রবাহের এক সতর্কবার্তায় বলা হয়, দেশের উপর দিয়ে চলমান তাপপ্রবাহ আজ (২৮শে এপ্রিল) হতে পরবর্তী ৭২ ঘণ্টা অব্যাহত থাকতে পারে। জলীয় বাষ্পের আধিক্যের কারণে অস্বস্তি বাড়তে পারে। গত ১৯শে এপ্রিল প্রথমবার সারা দেশে ৭২ ঘণ্টার হিট এলার্ট জারি করে আবহাওয়া অধিদপ্তর। সন্ধ্যায় আবহাওয়া অধিদপ্তরের দিনের শেষ আবহাওয়া বার্তায় বলা হয়, যশোর ও রাজশাহী জেলার উপর দিয়ে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ এবং টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, নওগাঁ, পাবনা ও নীলফামারী জেলাসহ খুলনা বিভাগের অবশিষ্টাংশের উপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। ময়মনসিংহ, মৌলভীবাজার, রাঙ্গামাটি, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী ও বান্দরবান জেলাসহ ঢাকা, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের অবশিষ্টাংশ এবং বরিশাল বিভাগের উপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে। সারা দেশে দিন এবং রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। জলীয় বাষ্পের আধিক্যের কারণে অস্বস্তিভাব বিরাজমান থাকতে পারে। এ ছাড়াও চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের দু-এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা/ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি/বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেইসঙ্গে কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে শিলাবৃষ্টি হতে পারে। এ ছাড়া দেশের অন্যত্র অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে।
ওদিকে এক সপ্তাহ বন্ধ থাকার পর খুলেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কিন্তু প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। প্রথম দিনেই দেশের বিভিন্ন এলাকার স্কুল-মাদ্রাসায় অনেক শিক্ষার্থী অসুস্থ হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও হিটস্ট্রোকে দুই শিক্ষক ও এক কলেজছাত্রসহ ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। চট্টগ্রামে কর্মস্থলে যাওয়ার পথে হিটস্ট্রোকে এক মাদ্রাসাশিক্ষকের মৃত্যু হয়েছে। মাওলানা মো. মোস্তাক আহমেদ কুতুবী আলকাদেরী (৫৫) নামের ওই শিক্ষক সকালে বোয়ালখালীর কালুরঘাটে ফেরি পারাপারের সময় হিটস্ট্রোক করেন। তার বাড়ি কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়া লেমশীখালী। তিনি বোয়ালখালী উপজেলার খিতাপচর আজিজিয়া মাবুদিয়া আলিম মাদ্রাসায় কর্মরত ছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, তীব্র গরম ও প্রখর রোদের মধ্যে ফেরিতে হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যান তিনি। পরে তাকে দ্রুত চমেক হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। যশোরে গরমে অসুস্থ হয়ে আহসান হাবিব নামের এক স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু হয়েছে। রোববার সকাল ৯টার দিকে এই ঘটনা ঘটে। আহসান হাবিব যশোর সদর উপজেলার আমদাবাদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। আমদাবাদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এজেডএম পারভেজ মাসুদ বলেন, শিক্ষক আহসান হাবিব আজ সকালে মাঠে কাজ করে ৯টার দিকে বিদ্যালয়ে এসে অসুস্থ হয়ে পড়েন। দ্রুত তাকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। যশোর জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আব্দুর রশিদ বলেন, আজ সকালে ওই স্কুলশিক্ষককে (আহসান হাবিব) মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছিল। রোগীর স্বজনরা জানিয়েছেন সকালে রোদের মধ্যে তিনি মাঠে কাজ করে স্কুলে গিয়েছেন। স্বজনদের দাবি, তার হিটস্ট্রোক হয়েছে। তবে আমরা এখনো চূড়ান্ত রিপোর্ট পাইনি। জরুরি বিভাগের চিকিৎসকের ধারণা তিনি হার্ট অ্যাটাকে মারা যেতে পারেন।
অন্যদিকে কিশোরগঞ্জে হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে শাহরিয়া আলম সাকিব (১৮) নামে এক কলেজশিক্ষার্থী মারা গেছেন। শনিবার সন্ধ্যায় কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার দানাপাটুলী ইউনিয়নের পশ্চিম মাথিয়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। সাকিব ওয়ালী নেওয়াজ খান কলেজের একাদশ শ্রেণির মানবিক শাখার ছাত্র। পারিবারিক সূত্র জানায়, শনিবার বিকালে হঠাৎ সাকিবের শরীরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। একপর্যায়ে সে অজ্ঞান হয়ে যায়। মুমূর্ষু অবস্থায় সন্ধ্যা ৭টার দিকে তাকে শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। শাহরিয়া আলম সাকিবের বাবা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমার এমন তরতাজা ছেলেটা এভাবে মারা যাবে কোনোদিন কল্পনাও করতে পারিনি। এই শোক আমি কেমন করে সইবো! এদিকে মাদারীপুরেও দুইজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। নিহত শাহাদাত সরদার (৫৫) কালকিনি পৌর এলাকার পশ্চিম শিকারমঙ্গল গ্রামের বাসিন্দা এবং মোসলেম ঘরামি (৬০) ডাসারের কাজী বাকাই ইউনিয়নের পূর্ব মাইজপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। শাহাদাত পেশায় একজন ব্যবসায়ী। তিনি সকালে গরমে নিজ বাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেখানেই মারা যান। আর দুপুরে মোসলেম ঘরামি নামে এক কৃষক অসুস্থ হয়ে মারা যান। মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলাউল হাসান ঘটনায় সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, প্রচ- গরমে দুইজন মারা যাওয়ার খবর পেয়েছি। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক।
এদিকে রাজধানীতেও গরমে একজনের মৃত্যু হয়েছে। মো. সেলিম মিয়া (৫০) নামে ওই ব্যক্তি দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে যাত্রাবাড়ীর কাজলা থেকে কাওরান বাজারে নিজের দোকানে ফেরার পথে সিএনজি অটোরিকশার মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। নিহত সেলিম মিয়ার ছেলে সাঈদ জানান, সিএনজির মধ্যেই গরমে তিনি অসুস্থ হয়ে অচেতন হয়ে পড়েন। পরে তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে গেলে চিকিৎসক বলেন তিনি আর বেঁচে নেই। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক মো. বাচ্চু মিয়া মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, মরদেহ বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মর্গে রাখা হয়েছে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট থানাকে অবগত করা হয়েছে।
নরসিংদীতেও তীব্র গরমে অসুস্থ হয়ে সুলতান উদ্দিন মিয়া (৭২) নামে এক বীর মুক্তিযোদ্ধা মারা গেছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। গতকাল বিকাল ৩টার দিকে নরসিংদী আদালত প্রাঙ্গণে এ ঘটনা ঘটে। তিনি নরসিংদী কোর্টে আইনজীবীর সহকারী (মুহুরি) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। নরসিংদী জেলা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক এমএন মিজানুর রহমান বলেন, হাসপাতালে নিয়ে আসার আগেই সুলতান উদ্দিনের মৃত্যু হয়েছে। ময়নাতদন্তের পর মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যাবে।
৫ জেলার স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা: দেশে চলমান দাবদাহের কারণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও আবহাওয়া অধিদপ্তরের সঙ্গে পরামর্শক্রমে ঢাকা, চুয়াডাঙ্গা, যশোর, খুলনা ও রাজশাহী জেলার সকল মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আজ বন্ধ থাকবে বলে ঘোষণা দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক বার্তায় বিষয়টি জানানো হয়। এতে আরও বলা হয়, তবে যে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আছে সেই সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ চাইলে খোলা রাখতে পারবে। আজ পরবর্তী সিদ্ধান্ত জানানো হবে। তবে এসব জেলায় প্রাথমিক স্কুল খোলা থাকবে বলে জানিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।