ঢাকায় প্রধান সড়ক থেকে অলিগলি সবখানে এখন ব্যাটারিচালিত রিকশার দাপট। কোনোভাবেই এগুলো রুখতে পারছে না ট্রাফিক পুলিশ। বাধা দিলেই তেড়ে আসছেন চালকেরা। অনেক সময় জোট হয়ে হামলাও করছেন পুলিশের ওপর। ফলে কোনোভাবে ঠেকানো যাচ্ছে না এসবের অবাধ বিচরণ। ঝুঁকিপূর্ণ এই বাহনের সংখ্যা গত কয়েক দিনে হু হু করে বেড়েছে।
গত মে মাসে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিন চাকার বাহনটি চলাচলের নির্দেশ দিলেও এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো প্রজ্ঞাপন হয়নি। ফলে পুলিশও এ ব্যাপারে তেমন কোনো নির্দেশনা পায়নি। এতে অভিযান চালাতে গেলেই রিকশার চালকরা বলে উঠছেন, এটার অনুমতি তো সাবেক প্রধানমন্ত্রীই দিয়ে গেছেন। কিন্তু ট্রাফিক পুলিশের যুক্তি- এ নিয়ে প্রজ্ঞাপন হয়নি। এতে ট্রাফিক সদস্যরা তাদের ধরবেন নাকি জরিমানা করবেন এটা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছেন। মাঝে মাঝে অভিযানও চালাচ্ছেন।
শুক্রবার (১৩ সেপ্টেম্বর) বেলা সাড়ে ১১টা। ধানমন্ডির আবাহনী মাঠের পশ্চিম পাশের প্রধান সড়কে ট্রাফিকের তিন দুই সদস্য কয়েকটি ব্যাটারিচালিত রিকশা থামান। এর মধ্যে একজন চালককে লঘু শাস্তি হিসেবে গাড়ির সিট তুলে উল্টে দিয়ে তাকে দাঁড় করিয়ে রাখেন। এরপর আরও দুটিকে থামানো হয়। পরে তিনজন বাহনের চালককে নামিয়ে এক সাথে দাঁড় করিয়ে ছবি তোলেন তারা। এসআই মনির তাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। তিনি বলছিলেন, বাহনটি প্রধান সড়কে চলাচলের অনুমতি নেই জেনেও কেন রাস্তায় নেমেছেন? চালকেরা এর কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। পরে তাদের ছেড়ে দেন পুলিশ কর্মকর্তা।
এসআই মনির যখন তাদের সাথে কথা বলছিলেন সেই মুহূর্তে তার পেছন পাশ দিয়ে সাঁই সাঁই করে ছুটে যাচ্ছিল অগণিত ব্যাটারিচালিত রিকশা। পরে পাশে থাকা টিআই সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, এই সড়কে অনেক রিকশা চলে। আমরা তিনজন মানুষ। কজনকে আটকাবো! তারা কয়েক মাস আগে আমাদের ওপর হামলা করেছে। তারপরও আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।
এ বিষয়ে ডিএমপির রমনা বিভাগের এডিসি মেহেদী হাসান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি প্রতিরোধ করার। একবারেই তো সম্ভব না। এজন্য সবার সহযোগিতা দরকার।’ তিনি নিজেই স্বীকার করেন, ধামমন্ডি এলাকায় এই রিকশার দাপট বেশি।
মাঠে থাকা ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা বলছেন, তাদের কাজ ব্যাটারিচালিত রিকশা ধরা ও জরিমানা করা। কিন্তু এটি একবারে বন্ধ করা সহজ নয়। নির্মূল করতে হলে ভোক্তা অধিদফতরকে এগিয়ে আসতে হবে। একই সাথে ট্রাফিক কন্ট্রোল, বিভিন্ন বাহনের জরিমানা ও রিকশা ধরতে অভিযান চালানো তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি যোগ হয়েছে যানজট নিরসনের অংশ হিসেবে ফুটপাত দখল করে বসা দোকান উচ্ছেদের কাজ। কিন্তু এখন তাদের জনবল কম। অন্যদিকে স্বৈরাচারী সরকারের পতনের সময় ঢাকার অধিকাংশ ট্রাফিক বক্স ও সাব অফিসগুলো ভাঙচুরের পাশাপাশি পুড়িয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা। এরপর থেকে তারা ছাদহীন। তাদের এখন রোদ বা বৃষ্টিতে দাঁড়ানোর মতো অবস্থাও নেই। ফলে ক্লান্ত শরীরে গাছের ছায়া তাদের শেষ ভরসা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকার হাজারীবাগ, রায়েরবাগ, লালবাগ, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, বাড্ডা, সবুজবাগ ও দক্ষিণখান এলাকায় গড়ে উঠেছে এই বাহন তৈরি ও মেরামতের কারখানা। এসব কারখানার কথা পুলিশ সদস্যরাও জানেন, কিন্তু ট্রাফিকের এখতিয়ারে না পড়ায় অভিযান চালান না তারা।
আরও জানা গেছে, ধানমন্ডি, ঢাকা উদান, হাজারীবাগ ও রায়েরবাগ এলাকায় অর্ধ শতাধিক রিকশার কারখানা গড়ে ওঠেছে। আগের সরকারের লোকজন এগুলোর অন্যতম উদ্যোক্তা ছিল। তাদের হাত ধরেই এই রিকশাগুলো ঢাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এখন সেই মালিকরাই নানাভাবে চালকদের সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছেন। কোনো চালক চলাচলে বাধার সম্মুখীন হলে লোকজন নিয়ে সেখানে হাজির হন তারা। ট্রাফিক পুলিশের ওপর হামলার নেপথ্যের কারিগরও এসব রিকশার মালিকরা। পুলিশের একাধিক মাঠ পর্যায়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলছেন, তারা সম্প্রতি এক মিটিংয়ে ঢাকায় যানজট নিরসনে ১৭টি পদক্ষেপ নিয়েছেন। যার একটি প্রধান সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল শূন্যের কোটায় আনা। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে তারা মাঠ পর্যায়ের প্রতিটি সদস্যদের নির্দেশও দিয়েছেন। কিন্তু এটি বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ের সদস্যরা কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছেন।
ধানমন্ডির জোনের এক টিআই নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমরা ব্যাটারিচালিত রিকশা ধরছি। কিন্তু ভয়ে থাকি। কখন তারা হামলা করে বসে। দেশ সচল হলেও আমাদের মাঝে আতঙ্ক কাটেনি। হাজার হাজার রিকশা ধরা গুটি কয়েক পুলিশ সদস্যের পক্ষে অসম্ভব।’
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে সাত মসজিদ রোড এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা ধরে জরিমানা করার সময় পুলিশ সদস্য ও পুলিশ বক্সে হামলা চালায় চালকরা। তারা একযোগে সেদিন রাস্তায় নেমে আসে। সেদিনের পরিস্থিতি তুলে ধরে ধানমন্ডিতে দায়িত্ব পালনকারী এক পুলিশ সদস্য বলেন, তখন অবস্থা এতটাই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল যে, পুলিশ তাদের নিয়ন্ত্রণে রাবার বুলেট পর্যন্ত ছুড়তে বাধ্য হয়েছে।
বিভিন্ন স্থানে ব্যাটারিচালিত রিকশা চালাতে বাধা দেওয়ার ঘটনায় গেল মে মাসে চালক ও মালিকরা মাঠে নামে এক যোগে। তখন বাধ্য হয়ে তাদের দাবি মেনে নেয় বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। এরপর থেকে প্রধান সড়কগুলোতে দাপটের সাথে চলছে এই বাহন। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে জনরোষে পুলিশ ছন্নছাড়া হয়ে যায়। এই সুযোগে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকদের দাপট আরও বেড়ে যায়।
রাজধানী ঢাকায় কতটি ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করে এর কোনো সঠিক সংখ্যা সিটি করপোরেশন, পুলিশ এমনকি ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে গড়ে ওঠা সংগঠনগুলোর কাছেও নেই। কেউ কেউ জানিয়েছেন, শুধু ঢাকাতেই অন্তত অর্ধ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করছে। সেগুলোর অধিকাংশের নেই কোনো অনুমোদন।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) খোন্দকার নাজমুল হাসান ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা আমাদের অভিযান অব্যাহত রেখেছি। সেপ্টেম্বর মাসে টার্গেট নিয়ে কাজ করছি। এই ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধে শুধু পুলিশ নয়, গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। ঝুঁকিপূর্ণ এই বাহনটিতে সাধারণ মানুষ ওঠা বন্ধ করলেই এটি প্রতিরোধ করা সম্ভব।