মসজিদ আল্লাহ তাআলার নিদর্শন ও ইসলামের প্রতীক। পৃথিবীতে সবচেয়ে পবিত্র ও মর্যাদাপূর্ণ স্থান মসজিদ। এটি ইবাদাতের স্থান এবং এর প্রতি সম্মান দেখানো ঈমানের দাবি। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘এসব মসজিদ বানানো হয়েছে আল্লাহর স্মরণ ও আলোচনা, নামাজ ও কোরআন পাঠের জন্য। (সহিহ মুসলিম: ২৮৫)
মসজিদে সম্মানবহির্ভূত কাজ নিষিদ্ধ। হাদিস শরিফে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা তোমাদের মসজিদকে অবুঝ শিশু ও পাগলদের থেকে দূরে রাখো, তদ্রুপ ক্রয়-বিক্রয়, বিচার-আচার, উচ্চৈঃস্বর, দণ্ডপ্রদান ও তরবারি কোষমুক্ত করা থেকে বিরত থাকো।’ (ইবনে মাজাহ: ৭৫০)
মসজিদে চেঁচামেচি ও শোরগোল কেয়ামতের আলামত। এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যখন লোকেরা জেহাদলব্ধ গনিমতের সম্পদকে নিজের সম্পত্তি বুঝবে, আমানতকে স্বীয় সম্পত্তি গণ্য করবে, জাকাতকে জরিমানা মনে করবে, দ্বীনি ইলম ছাড়া অন্য ইলম শিক্ষা করবে, পুরুষ স্ত্রীর তাঁবেদারি করবে, নিজ মায়ের নাফরমানি করবে, বন্ধু-বান্ধবকে ঘনিষ্ঠ ভাববে আর আপন পিতাকে দূরবর্তী বলে বুঝবে, মসজিদে উচ্চৈঃস্বর ও চেঁচামেচি বেড়ে যাবে, ফাসেক লোক সমাজের সর্দার হবে, সর্বাপেক্ষা নীচ প্রকৃতির লোক সমাজের কার্যভারপ্রাপ্ত হবে, জালেমকে তার জুলুমের ভয়ে লোক সম্মান করবে, নর্তকী ও বাদ্যযন্ত্র বিস্তার লাভ করবে, মদ প্রচুর পরিমাণে পান করা হবে, পরবর্তী লোকেরা পূর্বপুরুষকে মন্দ বলবে, তখন তোমরা এরূপ বিপদের অপেক্ষা করতে থাকবে যে, লালবর্ণের প্রচণ্ড বায়ু অথবা ভূমিকম্প, জমিন ধসে যাওয়া, লোকের রূপান্তর হওয়া ও পাথর বর্ষণ হওয়া ইত্যাদি পরিলক্ষিত হবে। আরও অনেক আপদ-বিপদ ধারাবাহিকভাবে আসতে থাকবে, যেমন মুক্তামালা ছিঁড়ে গেলে দানাসমূহ খসে পড়তে থাকে।’ (জামে তিরমিজি: ২২১০, ২২১১)
আলেমরা মসজিদে উচ্চৈঃস্বরে জিকিরের ক্ষেত্রেও সতর্ক করেছেন যে, উচ্চৈঃস্বরে জিকিরের কারণে নামাজি, কোরআন তেলাওয়াতকারী, অন্য ইবাদতকারী ও ইতেকাফকারীদের ঘুমের যেন ব্যাঘাত না হয়। নচেৎ উচ্চৈঃস্বরে জিকিরও নিষিদ্ধ হবে। (ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়া: ৬৩৯)
হজরত ওমর (রা.) মসজিদে আওয়াজ করার কারণে দুই ব্যক্তিকে শাসিয়ে দেন এই বলে যে- ‘তোমরা যদি এই মদিনা শহরের বাসিন্দা হতে, তাহলে মসজিদে উচ্চৈঃস্বরে কথা বলার কারণে আমি দুজনকেই কঠোর শাস্তি দিতাম।’ (বুখারি: ৪৭০)
এক হাদিস থেকে জানা যায়, জনৈক ব্যক্তি জোরে কথা বললে রাসুল (স.) রেগে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে তাকে ধমক দেন। (বুখারি: ৪৭১) আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুল (স.) ইরশাদ করেন- ‘তোমরা বিভেদ করো না তাহলে তোমাদের অন্তরে ভিন্নতা সৃষ্টি হবে। আর তোমরা মসজিদে বাজারের ন্যায় কোলাহল ও দ্বন্দ্ব-বিরোধ থেকে দূরে থাকবে।’ (মুসলিম: ৪৩২ আবু দাউদ: ৬৭৫)
আর যাদের কারণে মসজিদে ইবাদতে বাধা সৃষ্টি হয়, তাদের উদ্দেশে পবিত্র কোরআনে কঠিন হুঁশিয়ারি রয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আর তার চেয়ে অধিক জালিম আর কে হতে পারে, যে আল্লাহর মসজিদগুলোতে তার নাম স্মরণ করতে বাধা দেয় এবং এগুলো বিরাণ করার চেষ্টা করে? অথচ ভীত-সন্ত্রস্ত না হয়ে তাদের জন্য সেগুলোতে প্রবেশ করা সঙ্গত ছিল না। দুনিয়াতে তাদের জন্য লাঞ্ছনা ও আখেরাতে রয়েছে মহাশাস্তি।’ (সুরা বাকারা: ১১৪)
আরও যেসব কাজ মসজিদে করা যাবে না
মসজিদে কাউকে ডিঙিয়ে কাঁধের ওপর দিয়ে যাওয়া মসজিদের আদববিরোধী কাজ। (আবু দাউদ: ১১১৮)
রাজনৈতিক আলাপ ও মিটিং মসজিদের আদবের খেলাপ। (ফতোয়ায়ে রহিমিয়া: ৬/১০৫)
মসজিদে হারানো বস্তু তালাশ করা যাবে না। কারণ, মসজিদে দ্বীনের কথা বা কাজ ছাড়া অন্যকিছু নিষেধ। (মেশকাত: ৬৫৪)
মসজিদে দুর্গন্ধময় কোনো জিনিস নিয়ে প্রবেশ করা নিষেধ। (মেশকাত: ৬৫৫)
মসজিদে ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে না। (মেশকাত: ৬৭৭)
মসজিদের আদব হলো কেবলামুখী হয়ে বসা। তাই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসা অনুচিত: (সিলসিলাহ সহিহাহ: ২৬৪৫)
মসজিদে অপরাধীর শাস্তি ও শাসন করা যাবে না। (মেশকাত: ৬৭৯)
মসজিদের ভেতরে প্রতি ওয়াক্ত নামাজ একই স্থানে আদায় করার জন্য স্থান নির্দিষ্ট রাখতে পারবে না। যে যেখানে এসে প্রথমে স্থান নেবে, সেই সেখানে নামাজ আদায় করবে। একে অপরকে ওঠিয়ে বসা যাবে না। (রদ্দুল মুহতার: ১/৬৩০)
তবে, নামাজ ও ইবাদত-বন্দেগির উদ্দেশ্যে মসজিদে গমনের পর অবসরে মুসল্লিদের ব্যাঘাত না করে পরস্পর স্বাভাবিক আওয়াজে পার্থিব বৈধ কথাবার্তা বলা জায়েজ। হাদিস শরিফে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (স.) ফজরের নামাজের পর নামাজের স্থান থেকে সূর্যোদয়ের আগে উঠতেন না। এ অবস্থায় মুসল্লি সাহাবিরা পরস্পর স্বাভাবিক আওয়াজে কথাবার্তা বলতেন এবং জাহেলি যুগের গল্প করে হাসতেন। রাসুলুল্লাহ (স.)-ও তাদের গল্প শুনে মুচকি হাসতেন। (সহিহ মুসলিম: ৬৭০) তবে স্মর্তব্য যে, শুধু পার্থিব কথাবার্তা বলার উদ্দেশ্যেই মসজিদে গমন এবং আসর জমানো নাজায়েজ। (রদ্দুল মুহতার: ১/৬৬২)
উল্লেখ্য, মসজিদ পরিচালনা কমিটিতে এমন লোক থাকা উচিত, যারা মুত্তাকি, মসজিদের পবিত্রতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এবং প্রয়োজনীয় মাসয়ালা সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রাখেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারাই তো আল্লাহর মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ করবে, যারা ঈমান আনে আল্লাহ ও পরকালের ওপর। সালাত কায়েম করে, জাকাত দেয় এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করে না।…’ (সুরা তাওবা: ১৮)
যারা পদের লোভ করে, তাদেরকে কমিটিতে রাখা যাবে না। রাসুল (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘আমরা কোনো পদপ্রার্থী বা পদপ্রত্যাশীকে পদ দিই না।’ (বুখারি: ৭১৪৯) মসজিদ কমিটির সদস্যদের অবশ্যই আমানতদার হতে হবে। এছাড়াও মসজিদসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রকাশ্য পাপ ও অপ্রকাশ্য অপবিত্রতামুক্ত হতে হবে। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে আল্লাহর ঘরে আদববিরোধি কাজ করা থেকে দূরে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।