নিউ ইয়র্কের জাতিসংঘ সদর দপ্তরে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে অনুষ্ঠিত তিনদিন ব্যাপী উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলন শেষ হয়েছে। সম্মেলন শেষে একটি ৭ পৃষ্ঠার যৌথ ঘোষণা গ্রহণ করা হয়েছে যেখানে গাজায় যুদ্ধের অবিলম্বে সমাপ্তি এবং ইসরাইল-ফিলিস্তিনি সংঘাতের জন্য দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান বাস্তবায়নের একটি বিস্তৃত আন্তর্জাতিক রোডম্যাপ গ্রহণ করা হয়েছে। গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন বন্ধ এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য ‘দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান’কে ‘একমাত্র কার্যকর পথ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
‘নিউ ইয়র্ক ডিক্লারেশন অন দ্য পিসফুল সেটেলমেন্ট অব দ্য কোয়েশ্চন অফ প্যালেস্টাইন’ নামে পরিচিত এই ঘোষণাকে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বিশ্বব্যাপী অভূতপূর্ব ঐক্যমত্যের নিদর্শন হিসেবে বর্ণনা করেছে সম্মেলনের যৌথ আয়োজক ফ্রান্স ও সৌদি আরব। উল্লেখ্য, জাতিসংঘের ফিলিস্তিন বিষয়ক এই উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলন শুরু থেকেই বয়কট করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল।
সম্মেলনে জাতীয় অভিজ্ঞতার আলোকে দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের তাৎক্ষণিক বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন জাতিসংঘের এই উচ্চপর্যায়ের সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশের সংবিধান আমাদেরকে ‘অত্যাচারের শিকার মানুষের পাশে দাঁড়াতে এবং জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার সমর্থনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করে।’ তিনি আরও বলেন, আমাদের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে গত বছরের জুলাই ও আগস্টের গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষ সবসময়ই আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের চেষ্টা করেছে। আমাদের এই ঐতিহ্য ‘ফিলিস্তিনি জনগণের স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের ন্যায়সঙ্গত আকাঙ্ক্ষার প্রতি আমাদের সহমর্মিতা ও স্থায়ী সংহতি গড়ে তুলেছে’ উল্লেখ করে তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘দ্বিরাষ্ট্র ভিত্তিক সমাধানের বাস্তবায়ন এখনই শুরু করতে হবে।’ তিনি স্বীকার করেন যে, ‘শুধু কথায় ফিলিস্তিনি জনগণের যন্ত্রণা উপশম হবে না।’ তাই তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে গাজায় অবিলম্বে ও নিঃশর্ত যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়ন এবং খাদ্য ও জরুরি সেবার নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ নিশ্চিত করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘এই সম্মেলন থেকে আমরা আর আগের অবস্থানে ফিরে যেতে পারি না।’
যৌথ ঘোষণায় মিশর, কাতার ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ধাপে ধাপে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানো হয়েছে, যা শত্রুতা অবিলম্বে বন্ধ, বন্দিদের মুক্তি নিশ্চিতকরণ এবং গাজা থেকে ইসরাইলি বাহিনীর প্রত্যাহার নিশ্চিত করবে। এছাড়া, গাজা ও পশ্চিম তীরকে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে পুনঃএকত্রীকরণের প্রস্তাব রয়েছে এবং হামাসকে গাজায় ক্ষমতা ছাড়তে ও অস্ত্র সমর্পণের আহ্বান জানানো হয়েছে। ঘোষণায় ১৯৬৭ সালের সীমানার ভিত্তিতে দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের জন্য বৈশ্বিক সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে, যেখানে পূর্ব জেরুজালেম ভবিষ্যতের ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের রাজধানী হবে। এতে জোর দিয়ে বলা হয়েছে, ‘শুধুমাত্র রাজনৈতিক সমাধানই শান্তি বা নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে।’
ঘোষণায় ইসরাইলকে সমস্ত বসতি নির্মাণ কার্যক্রম বন্ধ করতে, বসতি-দাসত্ব বিরোধী সহিংসতা থামাতে এবং দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানে প্রকাশ্য পুনঃপ্রতিশ্রুতি দিতে আহ্বান জানানো হয়েছে। এতে সতর্ক করা হয়েছে যে, উভয় পক্ষের একতরফা পদক্ষেপ শান্তির পথে স্থায়ী প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে, এবং এমন কার্যক্রম ‘শেষ বাঁচা শান্তির পথ ধ্বংসের হুমকি’ দেয়। ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব ও শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি, গণতান্ত্রিক সংস্কার এবং উন্নত শাসনের পরিকল্পনাগুলোকে এই ঘোষণায় স্বাগত জানানো হয়েছে। ঘোষণায় একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন হিসেবে দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতা ও সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আঞ্চলিক নিরাপত্তা কাঠামো গঠনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, যা আসিয়ান বা ইউরোপীয় নিরাপত্তা ও সহযোগিতা সংস্থার মতো হবে। ভবিষ্যতে একটি ‘শান্তি দিবস’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবও দেয়া হয়েছে, যা সংঘাতের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি এবং আঞ্চলিক অর্থনীতি, শক্তি ও অবকাঠামো সমন্বয়ের সূচনা হিসেবে পালন করা হবে।
সম্মেলনের যৌথ সভাপতি সৌদি আরব ও ফ্রান্স আগামী সেপ্টেম্বর মাসে ৮০তম জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ঘোষণার অগ্রগতি প্রতিবেদন উপস্থাপন করবে এবং দ্বিরাষ্ট্রিক সমাধান বাস্তবায়নের জন্য গ্লোবাল অ্যালায়েন্সের আওতায় একটি অনুসরণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কাজ করবে বলে জানানো হয়েছে। ঘোষণার শেষদিকে বলা হয়েছে, ‘এটি একটি ঐতিহাসিক সুযোগ, সংঘাত শেষ করার, ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এবং উভয় জনগোষ্ঠীর জন্য শান্তি ও মর্যাদা নিশ্চিত করার জন্য এখনই সময়।’ এ প্রসঙ্গে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল বিন ফারহান আল-সৌদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমরা আপনাদের অনুরোধ করছি, ৭৯তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শেষ হওয়ার আগে নিউ ইয়র্কে সৌদি আরব ও ফ্রান্সের মিশনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে এই ঘোষণাকে সমর্থন করুন।’ এ উদ্যোগের মাধ্যমে সৌদি আরব ও ফ্রান্স বিশ্ব সম্প্রদায়কে একটি নতুন কূটনৈতিক প্রচেষ্টার সূচনা করার আহ্বান জানিয়েছে, যা বিশ্বের দীর্ঘতম এই সংঘর্ষের একটি স্থায়ী সমাধানের পথ তৈরি করবে।
এদিকে মার্কিন কংগ্রেসে জর্জিয়া অঙ্গরাজ্য থেকে নির্বাচিত কংগ্রেসওম্যান মার্জোরি টেইলর গ্রিন প্রথম রিপাবলিকান হিসেবে গাজার পরিস্থিতিকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে নিজ দলের অবস্থান থেকে স্পষ্টভাবে সরে দাঁড়িয়েছেন। তিনি বলেন, ‘৭ অক্টোবরের হামলা ছিল ভয়াবহ এবং সকল জিম্মিকে অবশ্যই মুক্ত করতে হবে, কিন্তু গাজায় যে গণহত্যা, মানবিক সংকট ও অনাহার চলছে সেটাও সত্য।’ তাঁর এই মন্তব্য রিপাবলিকান দলে ইসরাইলপন্থী অবস্থানের বিপরীতে ডানপন্থীদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সংশয়ের ইঙ্গিত দেয়। অপরদিকে, বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমার ঘোষণা দিয়েছেন, যদি ইসরাইল শান্তির পথে বিশ্বাসযোগ্য ও কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়- যেমন গাজায় তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি, পশ্চিম তীরে দখল বন্ধ এবং দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানে প্রতিশ্রুতি- তাহলে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেবে বৃটেন। তিনি জানান, এই স্বীকৃতি কেবল প্রতীকী নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ শান্তি রোডম্যাপের অংশ হবে- যা আগের বৃটিশ নীতির তুলনায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন।