২৪শে ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্র-নাগরিকের নতুন দল। শুরুতে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে আত্মপ্রকাশ করতে যাওয়া নতুন দলের পরবর্তীতে কমিটি পূর্ণাঙ্গ হবে। এখন চলছে নেতৃত্ব বাছাইয়ের তোড়জোড়। কারা থাকবেন কেন্দ্রীয় কমিটিতে, আর শীর্ষ পদে আসছেন কারা। তবে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের আওয়াজ তোলা গণ-অভ্যুত্থানের শক্তিগুলো নেতৃত্ব নিয়ে শুরুতেই টানাপড়েনের মধ্যে পড়েছে। তাদের দল গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে এক ধরনের অস্বস্তি নিয়ে। কারণ আহ্বায়ক চূড়ান্ত হলেও সদস্য সচিব নিয়ে দোটানা পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্দরে। যারা সবাই গণ-অভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন। বিষয়টি নিয়ে হতাশ নেতাকর্মীরা। তারা মনে করছেন, শুরুতেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় সংগঠন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কাছে ভুল বার্তা যাচ্ছে। যা নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের অন্তরায় হবে। বিষয়টির সমাধানে গতকাল রাজধানীর বাংলামোটরের রূপায়ণ ট্রেড সেন্টারে নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে ১৮৮ সদস্যের ১১০ জনের মতো উপস্থিত থাকলেও একটি অংশ বৈঠক বয়কট করে। তাদের দাবি জুলাই অভ্যুত্থানের মূল স্টেকহোল্ডারদের বাদ দিয়ে দল গঠন করতে চাইছে একটি অংশ। পরিচিত মুখের দোহাই দিয়ে তারা একক আধিপত্য বাস্তবায়ন করতে চাইছেন। শনিবার রাত থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নতুন দলের সদস্য সচিব কে হবে তা নিয়ে যুক্তি-তর্ক শুরু হয় দুই পক্ষের মধ্যে।
ছাত্রদের নতুন দলের কমিটিতে আহ্বায়কের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে এক নম্বর সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। যিনি বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার এবং আইসিটি উপদেষ্টা। দলের দায়িত্ব নেয়ার আগে নাহিদ উপদেষ্টা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করবেন। নাহিদের বিষয়ে ঐকমত্য হলেও সদস্য সচিব পদ নিয়ে বিভক্ত ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। একটি অংশ চাইছে নতুন দলের সদস্য সচিব হবেন ডাকসুর সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন। যিনি জাতীয় নাগরিক কমিটির বর্তমান সদস্য সচিব। আরেক অংশ চাইছে আন্দোলনের নেপথ্যের অন্যতম মুখ আলী আহসান জুনায়েদকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা শিবিরের সাবেক এ সভাপতি বর্তমানে নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়কের দায়িত্বে রয়েছেন। এ ছাড়াও এ পদের দাবিদার রয়েছেন আরও দুজন-তারা হলেন নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী ও মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম। আখতার ও জুনায়েদের মধ্য থেকে কেউ এ পদে না আসতে পারলে এদের নাম বিবেচনায় রাখা হয়েছে। আবার আখতার-জুনায়েদ দুজনের কাউকে চান না এমন একটি অংশও রয়েছে নাগরিক কমিটিতে। যারা নাসীরকে এ পদে দেখতে চান। এ ছাড়াও উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের অনুসারীরা চান শীর্ষ চার পদের একটিতে মাহফুজের বড় ভাই সাবেক ছাত্রদল নেতা মাহবুব আলম মাহিরকে স্থান দেয়া হোক। এসবের পেছনে উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের সম্পৃক্ততা নিয়েও আলোচনা রয়েছে নাগরিক কমিটির মধ্যে। তারা মনে করেন, সদস্য সচিব পদে মাহফুজ এমন কাউকে বসাতে চান যাকে তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। যদিও মাহফুজের অনুসারীরা এমন দাবি ভিত্তিহীন বলে জানিয়েছেন।
জুলাই অভ্যুত্থান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে শুরু হলেও এতে সর্বাত্মক অংশগ্রহণ ছিল শেখ হাসিনাবিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর। আবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটিতে থাকা বেশির ভাগ নেতাই গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তির নেতা ছিলেন। এটি ডাকসু’র সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেনের একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফরম। আন্দোলনে ছাত্রশিবিরের বর্তমান নেতাকর্মী ছাড়াও সাবেক নেতাদের একটি অংশের প্রত্যক্ষ অংশীদারিত্ব ছিল। যাদের অনেকে পরবর্তী জাতীয় নাগরিক কমিটিতে যোগ দিয়েছেন। এ ছাড়া বামপন্থি ছাত্রসংগঠনগুলোরও একটি অংশের অংশীদারিত্ব ছিল আন্দোলনে। তারাও আছেন নাগরিক কমিটিতে কিন্তু ১৭ই জুলাই থেকে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পেছনে নিজেদের ভূমিকার কথা বলে শিবির থেকে নাগরিক কমিটিতে আসা নেতারা তাদের হিস্যা চাইছেন। তাই নতুন রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির শীর্ষ পদের একটি তাদের দাবি। কিন্তু নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেনের অনুসারীদের দাবি শিবিরের কাউকে এ পদে আনা হলে শুরুতেই দলটি গ্রহণযোগ্যতা হারাবে। তাই এ পদে আখতারই ভালো পছন্দ হতে পারে। আর আহ্বায়ক পদে নাহিদ ইসলামের বিষয়ে দুই পক্ষেরই ঐকমত্য রয়েছে।
একটি অংশের অনুপস্থিতিতে গতকালকের বৈঠকে নতুন দলের কেন্দ্রীয় কমিটির জন্য ৭৫ জনের মতো নাম চূড়ান্ত করা হয়েছে। ২৪শে ফেব্রুয়ারির আগে কমিটির আকার ২০০ এর কম বেশিতে উত্তীর্ণ করা হবে বলে জানা গেছে। কমিটির সদস্য সচিব পদ নিয়ে যখন আখতার ও জুনায়েদ অনুসারীরা বিভাজিত তখন নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নতুন দলের কমিটিতে নিজেদের ৫০ শতাংশ করে প্রতিনিধি নিশ্চিত করতে চাইছেন। ওদিকে সারা দেশে নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যে কমিটি দিচ্ছে বেশির ভাগ কমিটিতেই ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতাদের বড় অংশদারিত্ব রয়েছে বলে একটি অংশের দাবি। তারা মনে করেন, তৃণমূল থেকে কেন্দ্রে তাদের সমর্থন না থাকলে নতুন দলকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। অন্যদিকে গতকালকের বৈঠক বয়কট করা অংশটি আগামী ২২শে ফেব্রুয়ারি জুলাই বিপ্লবী কাউন্সিলের ব্যানারে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক সমাবেশের ডাক দিয়েছে। এতে জুলাই বিপ্লবের ১৩৫ সংগঠনসহ নানা সংগঠনের মানুষ অংশ নেবে বলে আয়োজকরা জানিয়েছেন। এ সমাবেশ থেকে সরকারকে তিন দফা দাবি জানানো হবে। দাবিগুলো হলো- পিলখানা, শাপলা ও জুলাই গণত্যার বিচার; আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা। এ সমাবেশ সফল ও ব্যর্থ হওয়ার ওপর নির্ভর করছে নতুন দলের ভাগ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে। যারা আলাদা সমাবেশ ডেকেছেন তারা এটিতে সফল হলে ওইদিনই রাজনৈতিক দলের ঘোষণা দিতে পারেন বলেও আলোচনা আছে।
গতকাল সন্ধ্যায় জাতীয় নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব মানবজমিনকে বলেন, নতুন রাজনৈতিক দল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক কমিটি ও জুলাই অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া নাগরিকদের নিয়ে গঠিত হবে। এটি নাগরিক কমিটির একক কোনো সিদ্ধান্ত নয়। সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে কমিটি চূড়ান্ত করা হবে। কমিটি কতো সদস্যের হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, একটি রাজনৈতিক দলের কমিটি হিসেবে ২০০ এর কম বেশি হতে পারে। আর নেতৃত্ব নিয়ে বিরোধের বিষয়ে তিনি বলেন, নেতৃত্ব নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। একটি পক্ষ আখতার হোসেন ও আলী আহসান জুনায়েদকে মুখোখুখি দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন। আশা করি এটি কেটে যাবে। ঐক্যবদ্ধভাবে রাজনৈতিক দল গঠন করা হবে।
এদিকে জাতীয় নাগরিক কমিটির আরেক যুগ্ম সদস্য সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে মানবজমিনকে বলেন, শুরুতে এমন আস্থার সংকট তৃণমূলে বিভ্রান্তি তৈরি করবে। সাধারণ মানুষও আস্থা হারাবে নতুন দলের প্রতি। আমরা চাই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব নির্বাচিত হোক। কিন্তু কেউ কেউ এ পদে একমাত্র নিজেই যোগ্য বলে ধরে নিচ্ছেন। যেটি ঠিক নয়। তিনি বলেন, ইনক্লুসিভ পলিটিক্স করতে এসে পদের জন্য গো ধরে বসে থাকা কোনো সংগঠনের জন্য সুখকর নয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক নেতা বলেন, একটি অংশ শীর্ষ চার পদের দুটিই চায়। কিন্তু আমাদের চিন্তা করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষের মধ্যে তার গ্রহণযোগ্যতা আছে কিনা। আমরা শুরুতে সংগঠনকে বিতর্কিত করতে চাই না। আরেক শীর্ষ নেতা বলেন, সংগঠনে আমাদের বিশাল কন্ট্রিবিউশন রয়েছে। আমাদের অনুসারী অনেক রয়েছেন। নির্বাচন দিলে আমাদের লোকই এ পদের জন্য নির্বাচিত হবেন। কিন্তু সেখানে নির্দিষ্ট কাউকে সরাসরি মনোনীত করার বিরোধী আমরা। ওদিকে গত শনিবার রাত থেকে আখতার ও জুনায়েদের অনুসারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন। কেউ লিখছেন আখতারকেই তারা নেতা মানেন আর কাউকে নয়। কেউ লিখছেন- আখতারকে মাইনাস করতে চায় কে? বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসুদ লেখেন- আমার ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনীতিতে আসা আখতার হোসেনের হাত ধরেই। এদেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি উনার ভালোবাসা সবসময় আমাদের মুগ্ধ করেছে। ঢাবি ক্যাম্পাসে একক নেতৃত্বে ছাত্রলীগ নামক সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সবসময় রুখে দাঁড়িয়েছেন। বারবার হামলার সম্মুখীন হয়েছেন, আহত হয়েছেন, কারারুদ্ধ হয়েছেন। কিন্তু সঙ্গীদের একমুহূর্তের জন্যও ছেড়ে যাননি। কোনো যদি-কিন্তু ছাড়া সচেতন নাগরিক হিসেবে আখতার হোসেনের পাশে আছি। অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সানজানা আফিফা অদিতি এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখেন, নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের মধ্যে সংগঠনগুলোর প্রধান পদগুলোতে কাদের দায়িত্ব দেয়া হবে তা অবশ্যই ওই সংগঠনের সকলের মতামতের ভিত্তিতে নির্ধারণ করতে হবে। অন্তত প্রথম দশজনের সিদ্ধান্ত মানুষের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। আগের মতোই যদি একজন দুইজনই সব সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে সেই নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সঙ্গে আমার যাত্রা দীর্ঘায়িত করবো না।