সর্বশেষ
Home » অন্যান্য » কৃষিতে তাপপ্রবাহের প্রভাব

কৃষিতে তাপপ্রবাহের প্রভাব

প্রায় এক সপ্তাহ ধরে সারা দেশের তাপমাত্রা ৩৮, ৩৯ ও ৪০ ডিগ্রিতে ওঠানামা করছে। তাপমাত্রা কোথাও কোথাও ৪২ ডিগ্রি ছাড়িয়েছে। তবে অনুভব হচ্ছে আরও বেশি। এরকম তীব্র দাবদাহের প্রভাব পড়ছে কৃষি উৎপাদনে। পুড়ছে ফসলের মাঠ। ফলে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে দেশের কৃষি খাত। এদিকে বৈশাখ মাস শেষ হতে চললেও বৃষ্টির দেখা নেই। প্রখর এই খরতাপে কৃষকের ফসল পুড়ে হচ্ছে নষ্ট। পাশাপাশি বিদ্যুতের সীমাহীন লোডশেডিংয়ে বিঘিœত হচ্ছে ইরি-বোরো ধানক্ষেতের পানি সেচ। এতে পুড়ে যাচ্ছে ভুট্টা, গম, বাদামসহ বিভিন্ন জেলার চরাঞ্চলের ফসলের ক্ষেত।

বাড়তি সেচে বাড়ছে উৎপাদন খরচ। এ অবস্থায় ফলন বিপর্যয়ের আশঙ্কায় দুশ্চিন্তার ভাঁজ কৃষকের কপালে। এরই মধ্যে অসহনীয় লোডশেডিং জনজীবনে বাড়িয়েছে দুর্ভোগের মাত্রা। অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে গ্রামগঞ্জ ও শহরের জনজীবন। এদিকে বিভিন্ন জেলার প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদনেও এসব চিত্র পাওয়া গেছে।
কৃষকরা বলছেন, এপ্রিলের দাবদাহ ও অনাবৃষ্টির কারণে ফলনে বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন তারা। চলতি মৌসুমে উচ্চ ফলন ও দাম ভালো পাওয়ার আশা ছিল তাদের। কিন্তু তীব্র দাবদাহের কারণে লাভের পরিবর্তে লোকসানের শঙ্কায় রয়েছেন তারা। হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেও ফসল রক্ষায় ব্যর্থ হচ্ছেন তারা। ভুট্টা, মরিচ, শাকসবজিসহ বিভিন্ন ফসল মাঠেই নষ্ট হচ্ছে।

কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, তীব্র দাবদাহ ও খরতাপে কৃষকের ফসল পুড়ে নষ্ট হচ্ছে। আর ক’দিন পরেই পুষ্টিকর খাবার বাদাম চরাঞ্চলের কৃষকদের ঘরে তোলার কথা। কিন্তু তীব্র খরায় বা প্রখর রৌদ্রে চরাঞ্চলের বাদাম ক্ষেতেই শুকিয়ে যাচ্ছে। সেচ দিয়েও খুব একটা কাজে আসছে না। একই অবস্থা সোনালি আঁশ পাট বীজ বপন করে কৃষকরা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। সেচ দিয়েও খুব একটা কাজে আসছে না। স্যালো ইঞ্জিন দিয়ে সেচ দিতে না দিতেই তীব্র খরায় শুকিয়ে যাচ্ছে ক্ষেত। এতে বাড়ছে কৃষকের উৎপাদন খরচ। প্রকৃতির বিরূপতায় চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে কৃষিকাজ। বৈরী আবহাওয়ার পরিবর্তন না হলে কৃষিতে বিপর্যয় ঘটবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এরকম অবস্থায় বিভাগীয় ও জেলা শহরে বিদ্যুতের লোডশেডিং কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে থাকলেও গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ ২৪ ঘণ্টায় ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা থাকছে।

এদিকে সরকার ইতিমধ্যেই হিট এলার্ট জারি করেছে। বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বিপণিবিতানগুলোতে কমেছে ক্রেতার ভিড়। ঈদের ছুটি শেষে শিল্পকারখানায় পুরো দমে উৎপাদন শুরু হয়েছে। চরম দুর্ভোগে পড়েছেন রিকশাচালক, দিনমজুর, নির্মাণ শ্রমিক, কুলি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। তীব্র গরমের কারণে তারা চাহিদামতো কাজ করতে পারছেন না। হিটস্ট্রোকে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে।
মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, বোরো ধানে হিটশক (তাপজনিত ক্ষতি) বা গরম বাতাস (৩৫ ডিগ্রি) প্রবাহ হলে ধান চিটা হতে পারে। তাই এ মুহূর্তে জমিতে ২-৩ ইঞ্চি পানি থাকতেই হবে। না হলে উৎপাদন কমে যাবে। আম, কাঁঠাল এবং লিচু গাছের গোড়ায় পর্যাপ্ত (৭-১০ দিন অন্তর) সেচ প্রদান করতে হবে। প্রয়োজনে গাছের শাখা-প্রশাখায় পানি স্প্রে করে দিতে হবে। প্রয়োজনে প্লাবন পদ্ধতিতে সেচ দেয়া যেতে পারে। এতে ফল ঝরে পড়া কমবে এবং ফলন বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া মাটিতে রস ধরে রাখার জন্য সেচের পর গাছের গোড়ায় মালচিং দেয়া যেতে পারে। তিনি বলেন, প্রাণিসম্পদের তাপপ্রবাহজনিত পীড়ন (স্ট্রেস) সহনশীল করতে, গবাদিপশু, পোল্ট্র্রির ঘর শীতল রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। মাছ চাষে তুলনামূলক কম গভীরতার পুকুরে নতুন পানি যোগ করে গভীরতা কমপক্ষে ৫ ফুট করতে হবে। এ ছাড়া বেগুন, টমেটো, মরিচ, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, করলা, ঝিঙা, চিচিঙ্গা, পটোল, শসা ও ঢ্যাঁড়শ প্রভৃতি ক্ষেতে তিন-চারদিন অন্তর সেচ দিতে হবে। অন্যদিকে পাতাজাতীয় সবজি যেমন- ডাঁটা, লালশাক, পুঁইশাক, কলমি, লাউশাক প্রভৃতি ক্ষেতে দুই-তিনদিন অন্তর সেচ প্রয়োগ করতে হবে।

গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার চরাঞ্চলের উড়িয়া ইউনিয়নের কাবিলপুর গ্রামের আব্দুল ছাত্তার মিয়া বলেন, দুই বিঘা জমিতে ভুট্টা লাগাইছি। মুচি পরিপক্ব হওয়ার সময় থেকে প্রচণ্ড তাপ। বালু জমির কারণে পানি ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তাই ভুট্টার গাছসহ মুচি মরে যাচ্ছে। আরেক চাষি খাইরুল বলেন, তিন বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করেছি। গত বছরে প্রতি বিঘায় ২৫ থেকে ৩০ মণ করে হলেও এবার দশ বারো মণ হবে কিনা সন্দেহ আছে। এবার আমরা ব্যাপক ক্ষতিতে পড়বো।
সাদুল্লাপুর উপজেলার ধাপের হাট এলাকার কৃষক আজিম উদ্দিন সরকার বলেন, টমেটো আর বেগুনের গাছ তাপের কারণে পুড়ে যাচ্ছে।

কৃষক মান্নান জানান, এ বছর ৮ বিঘা জমিতে বাদাম চাষ করেছি। অতিরিক্ত খরার কারণে ক্ষেতের সব বাদাম পুড়ে গেছে। এলাকায় এ বছরে বৃষ্টি নাই, সেচ দিয়ে বাদাম রক্ষা করাও সম্ভব হচ্ছে না। অতিরিক্ত রৌদ্রের তাপে সব নষ্ট হয়ে গেছে। ক্ষতি পোষাতে সরকারি সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।
কৃষি কর্মকতা মো. মিন্টু মিয়া বলেন, প্রচণ্ড গরম ও তাপের কারণে চরাঞ্চলে ভুট্টা, টমটো আর পাটের ক্ষতি হতে রেহাই পেতে এসব ফসল রক্ষায় গাছের গোড়ায় সময় স্যাঁতস্যাঁতে পানি ধরে রাখতে হবে।
জামালপুর প্রতিনিধি জনান, জেলার চরাঞ্চলের বাসিন্দারা বলেছেন, দিনে কতোবার আসে-যায় তার কোনো হিসাব নেই। যদি এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে তো দুই থেকে তিন ঘণ্টা নেই। এর মধ্যে আসা যাওয়ার ভেলকিবাজি তো আছেই। বিদ্যুতের অভাবে ইরি-বোরে ক্ষেতে সেচ দিতে পারছেন না কৃষকরা। অনেকে বাধ্য হয়ে বিদ্যুৎ পাম্পের পাশাপাশি ডিজেলচালিত পাম্প ব্যবহার করছেন। এতে বাড়ছে উৎপাদন খরচও। এতে ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে শঙ্কিত জেলা কৃষি বিভাগ।
রোদ-গরম উপেক্ষা করে মাঠে কাজ করতে গিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন নীলফামারীর কৃষি শ্রমিকরা। পাশাপাশি লোডশেডিংয়ে ব্যাহত হচ্ছে বোরো আবাদসহ শিল্পকারখানার উৎপাদন।

মেহেরপুর: তীব্র তাপপ্রবাহ ও অনাবৃষ্টির কারণে মেহেরপুরে কৃষিতে ফলন বিপর্যয়ের অশনি সংকেত দেখা দিয়েছে। তীব্র তাপপ্রবাহ ও অনাবৃষ্টিতে পুড়ছে কৃষকের মাঠ। অনাবৃষ্টি ও খরার হাত থেকে ফসল রক্ষায় কৃষকের সেচ সুবিধা ব্যয় বেড়েছে কয়েকগুণ। তবে ফলন বিপর্যয় ঠেকাতে কৃষকদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।
পাবনার বেড়া উপজেলার বিভিন্ন চরাঞ্চলে ভয়াবহ খরা দেখা দিয়েছে। তাপপ্রবাহ ও খরার কবলে পড়ায় চলতি বছর পটোলের ফলনে বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন স্থানীয় চাষিরা। বেড়া উপজেলা উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা বলেন, খরার কারণে কিছু পরিমাণ চিনাবাদাম, তিল গাছ ও পটোল গাছ মরে গেছে। আবার অনেক গাছ নুয়ে পড়েছে।

শেরপুর জেলায় লোডশেডিংয়ের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে জেলার বোরো ধানের আবাদেও। কৃষি বিভাগের তথ্যানুসারে, চলতি মৌসুমে শেরপুর জেলা জুড়ে ৯১ হাজার ৯৪২ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চাষ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ধানক্ষেতে ধান পুষ্ট হতে শুরু করেছে। তবে এরই মধ্যে লোডশেডিং শুরু হওয়ায় চাহিদামাফিক সেচ দিতে পারছেন না জেলার কৃষকরা। ফলে ধানের আশানুরূপ ফলন পাওয়া নিয়ে শঙ্কা তাদের মনে। বিদ্যুতের ঘন ঘন যাওয়া-আসা এবং ভোল্টেজ কম থাকায় সেচ পাম্পের মোটরও পুড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। সেচ পাম্পের মালিকরাও আছে বিপাকে।
সদর উপজেলার আরেক কৃষক শামসুল মিয়া বলেন, “দিনে কারেন্ট থাহে ৪-৬ ঘণ্টা, কিন্তু ভোল্টেজ তো থাহে না। কম ভোল্টেজে মোটর চালু দিলে তো মোটর পুইড়া যায়।”
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম-সম্পাদক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার জানান, বাতাসে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ কমে যাওয়ায় তাপমাত্রা বাড়ছে। বাংলাদেশের ও বিশেষ করে ঢাকার তাপমাত্রা বাড়ার বড় কারণ স্থানীয়। এক সময় দেশের ২৫ শতাংশ বনাঞ্চল থাকলেও বর্তমানে এর পরিমাণ খুবই কম। এ ছাড়া শহরের গাছপালা ও জলাশয় ভরাট করে ফেলা হচ্ছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে সবুজ ও জলাশয়ের পরিমাণ বাড়াতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *