ওয়ারেন বাফেট এক বিস্ময়ের নাম। বিলিয়নেয়ার বাফেট বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তি। কিন্তু তার জীবনাচরণে নেই কোনো বিলাসিতা। অন্য বিলিয়নেয়ারদের মতো চাকচিক্য নেই। প্রয়োজনের অধিক খরচ করেন না।  অনেক বিলিয়নেয়ারের মতো, তিনি কখনও বিলাসিতায় আকৃষ্ট হননি। অকারণে উড়াননি টাকা। পছন্দ করেন ফাস্ট ফুড। এখন তিনি ১৬৮২০ কোটি ডলারের মালিক। মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়েছে। বয়স পৌঁছে গেছে ৯৪ বছরে। তাই বেঁচে থাকতেই সম্পদের একটি সুরাহা করে যেতে চান। বলেছেন, এ সম্পদের প্রায় পুরোটাই তিনি দান করে যাবেন। ১৯৫৮ সালে যে বাড়ি কিনেছিলেন সেই একই বাড়িতে এখনও থাকেন। এখনও প্রতিদিন পান করেন বেশ কয়েকটি ক্যান কোকা-কোলা। ওয়ারেন বাফেট ‘ওরাকল অব ওমাহা’ নামে পরিচিত। তিনি বুদ্ধিমান। দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের মাধ্যমে গড়ে তুলেছেন ভাগ্য। এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা এএফপি। 

তার উত্তরাধিকার: বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ে তার কোম্পানি। নেব্রাস্কাভিত্তিক এই কোম্পানিটির আছে বিভিন্ন হোল্ডিং, রয়েছে ডুরাসেল ব্যাটারি থেকে শুরু করে বীমাকারী গেইকো, রঙের ব্র্যান্ড থেকে শুরু করে হীরা পর্যন্ত। কোম্পানিটি কোকা-কোলা এবং শেভরনের মতো মার্কিন কর্পোরেট জায়ান্টগুলিতে সাবধানে অংশীদারিত্ব ধারণ করে। ওয়ারেন বাফেটের বয়স এখন ৯৪ বছর। কত আর! বয়স তাকে আর সাপোর্ট দিচ্ছে না। তাই তিনি নিজের তৈরি কোম্পানি থেকে সরে দাঁড়াতে প্রস্তুত। শনিবার ঘোষণা করেছেন,  তিনি এ বছরের শেষে পদত্যাগ করার পরিকল্পনা করছেন। তার নির্বাচিত উত্তরসূরি গ্রেগ অ্যাবেলকে বার্কশায়ারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে তার স্থলাভিষিক্ত করার সুপারিশ করবেন। 

ফোর্বস ম্যাগাজিনের রিয়েল-টাইম ধনীদের তালিকা অনুসারে, শনিবার পর্যন্ত বাফেটের মোট সম্পদের পরিমাণ ১৬৮.২ বিলিয়ন ডলার – যা বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম সম্পদ। তবুও তিনি এখনও ওমাহার একটি শান্ত পাড়ায় একই বাড়িতে থাকেন। তিনি ১৯৫৮ সালে ৩১,৫০০ ডলারে কিনেছিলেন এই বাড়ি। তাকে আলিশান স্বপ্ন বিমোহিত করেনি। সেই বাড়িতেই পুরো জীবন কাটিয়ে দিলেন। চাইলে তিনি আকাশচুম্বী অথবা আরও বিলাসী কোনো বাসায় সময় কাটাতে পারতেন। কিন্তু তা করেননি। খাবারের বিষয়ে নিঃসন্দেহে তিনি খুবই বাছাই করে চলেন। সপ্তাহে অন্তত তিনবার ম্যাকডোনাল্ডস চিকেন ম্যাকনাগেটস, স্ন্যাকসের জন্য আলুর কুঁচি, ডেজার্টের জন্য আইসক্রিম এবং প্রতিদিন গড়ে পাঁচ ক্যান কোকা-কোলা পান করেন। তার শখের মধ্যে রয়েছে ব্রিজ এবং উকুলেলে বাজানো। ২০১৩ সালে সিবিএসকে বাফেট বলেছিলেন, আমার অভিনব পোশাকের দরকার নেই। আমার অভিনব খাবারের দরকার নেই। তবুও ২০০৬ সালে স্বীকার করেন তার একটি ব্যক্তিগত জেট ছিল। এই খাতে যে ব্যয় তা তার জীবনকে আরও সহজ করে তুলেছে।

দানশীলতা: একই বছর, বাফেট ঘোষণা করেন তিনি তার সম্পত্তির ৯৯ শতাংশ জনহিতকর কাজে দান করবেন। তার বন্ধু এবং অংশীদার বিল গেটসের সাথে যোগ দিয়ে পরবর্তীতে অন্য বিলিয়নেয়ারদের তাদের সম্পদের অন্তত অর্ধেক দান করার প্রতিশ্রুতি দিতে রাজি করান বাফেট। এই ধরনের প্রচারণা বাফেটকে মার্কিন সমাজের একজন প্রিয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে। এই ঘটনা প্রতি বসন্তে ওমাহায় বার্কশায়ারের বার্ষিক সভায় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করতে সাহায্য করেছে। এই সমাবেশকে ‘উডস্টক ফর ক্যাপিটালিস্টস’ বলা হয়। বাফেট অতীতে ডেমোক্রেটিক পার্টিকে সমর্থন করার বিষয়ে খোলাখুলিভাবে কথা বলেছেন। প্রায়শই এই মতামত প্রকাশ করেছেন যে, তার সম্পদের কারণে তার কর আরও বেশি হওয়া উচিত ছিল।

প্রাথমিক ব্যবসায়িক প্রবৃত্তি: তিন সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় হিসেবে ১৯৩০ সালের ৩০শে আগস্ট ওমাহায় জন্মগ্রহণকারী বাফেট ছোটবেলায় ‘ওয়ান থাউজেন্ড ওয়েজ টু মেক ১,০০০ ডলার’ বইটি পড়ার পর ব্যবসার প্রতি তার আগ্রহ তৈরি হয়। বাফেটের শৈশব খুব একটা সহজ ছিল না। তিনি বর্ণনা করেছেন, দোকানপাট চুরির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল তার সময়। তার মা নির্যাতন করতেন। তবু তার সঙ্গে থাকতে হতো। বাফেট তার পড়াশোনা ছেড়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু তার পিতা ছিলেন একজন ব্যবসায়ী এবং রাজনীতিবিদ। কংগ্রেসে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাফেটের পড়া ছেড়ে দেয়ার ধারণার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন তিনি। বাফেট নেব্রাস্কা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তরিত হওয়ার আগে পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। সেখানে তিনি ব্যবসায় ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে তিনি ১৯৫১ সালে নিউ ইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
বাফেট ১৯৫০-এর দশকে ওয়াল স্ট্রিটে কাজ করেছিলেন। বাফেট পার্টনারশিপ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন- যা ১৯৬৫ সালে বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ের সাথে একীভূত হয়। এটা তখন ছিল একটি টেক্সটাইল প্রতিষ্ঠান। তিনি বার্কশায়ারকে একটি সুদূরপ্রসারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন। এই প্রতিষ্ঠান জ্বালানি, ব্যাংকিং, বিমান ভ্রমণ এবং খাদ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে বিনিয়োগের জন্য পরিচিত। সিটিগ্রুপ, ক্রোগার, অ্যাপল এবং আমেরিকান এক্সপ্রেসের মতো প্রতিষ্ঠানের মালিকানাও এর মধ্যে রয়েছে।

৯০ এর দশকে সক্রিয়: ক্লাসিক ধূসর স্যুট, চশমা এবং রঙিন টাই পরা সাদা চুলের বাফেট তার ৯০ এর দশকেও মার্কিন ব্যবসায়িক দৃশ্যপটে একজন প্রাণবন্ত মানুষ। দীর্ঘদিন ধরে তার ভাইস চেয়ারম্যান চার্লি মুঙ্গারের সাথে বার্কশায়ার পরিচালনা করেছেন। তারপর ২০২১ সালে যখন বাফেট ৯০ বছর বয়সে পা রাখেন, তখন বার্কশায়ার আনুষ্ঠানিকভাবে অ্যাবেলকে তার উত্তরসূরি হিসেবে মনোনীত করেন। সেই পরিকল্পনা এখন কার্যকর হতে চলেছে। বাফেট ১৯৫২ সালে তার প্রথম স্ত্রী সুসানকে বিয়ে করেন। তাদের তিনটি সন্তান হয়। তবে এই দম্পতি কয়েক দশক ধরে আলাদা বসবাস করেন। তবু ২০০৪ সালে সুসানের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন।
পরবর্তীতে ২০০৬ সালে দীর্ঘদিনের সঙ্গী অ্যাস্ট্রিড মেনকসকে বিয়ে করেন বাফেট।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here