গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন অবশেষে তার রিপোর্ট জমা দিয়েছে। রিপোর্টে কিছু বাস্তব ও কিছু অবাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে। অনেক ক্ষেত্রে উদ্ভট সুপারিশও স্থান পেয়েছে। কে সাংবাদিক হতে পারবে, কে পারবে না তা নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। নতুনত্বও এখানে অনুপস্থিত। সম্পাদক হওয়ার ক্ষেত্রে এই নিয়ম আগেই ছিল। প্রশ্ন হলো, জেলা-উপজেলা পর্যায়ে এই সিদ্ধান্ত কি কার্যকর করা যাবে? অনেকেই হয়তো বলবেন, একজন আরজ আলী মাতুব্বরের জীবন কাহিনী কি এই ইতিহাস থেকে মুছে যাবে? একটি সার্টিফিকেট  কি এক ‘অরাজক’ এবং ‘বিশৃঙ্খল’ অবস্থা থেকে সংবাদমাধ্যমকে মুক্ত করতে পারবে? দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বেহাল। কেউ বিনিয়োগ করতে আসছে না। প্রতিনিয়ত শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। লাখ লাখ শ্রমিক চাকরি হারিয়ে বেকার। সংবাদমাধ্যম এর বাইরে নয়। বড় বড় মিডিয়া হাউসগুলো ছাঁটাই কাজ অব্যাহত রেখেছে। যদিও পালাবদলে এক ধরনের অস্থিরতাও আছে। এই অবস্থায় যখন মিডিয়া কমিশন বিসিএস ক্যাডারের মতো সাংবাদিকদের বেতন নির্ধারণ করতে চায় তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে- কমিশন সদস্যরা কি অন্যগ্রহের মানুষ! নাকি বড় হাউসের পাশে থেকে বাস্তবতাকে অস্বীকার করছেন! ব্যবসাটা যেখানে সম্পূর্ণ ব্যক্তি মালিকানাধীন সেখানে বাস্তবকে অস্বীকার করে কোনো কিছু চাপিয়ে দেয়ার অর্থ হবে- ছোট ছোট সংবাদমাধ্যমকে গলা চেপে হত্যা করা। 

তাছাড়া সংবাদমাধ্যমে বেতন কাঠামো কেন সরকার নির্ধারণ করবে? শুধু সরকারি বিজ্ঞাপনের সুযোগ নিয়েই কি এই সিদ্ধান্ত চাপানো হচ্ছে? কেবল সরকারি বিজ্ঞাপন দিয়েই কি একটা সংবাদপত্র টিকে থাকতে পারে? রাজনৈতিক সংবাদপত্র হয়তো পারে। এর একটা ম্যাজিক আছে বটে। কোন হাউস কয়টা পত্রিকা বা টেলিভিশন চালু করতে পারবে সেটা নিয়ন্ত্রণ করার কোনো বৈধ যুক্তি নেই। যার বৈধ টাকা আছে সে কেন পারবে না। কোনো একটা বিজনেস হাউসকে টার্গেট করে এই সুপারিশ আনা হলে মূল উদ্দেশ্য নিয়েই প্রশ্ন উঠবে। অন্তত দুটি বিজনেস হাউস বাংলাদেশে মিডিয়া বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে।

আনন্দবাজার পত্রিকা গ্রুপের অনেক পত্রিকা রয়েছে। ভারত সরকার কি এ ব্যাপারে কোনো নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে? তাই ‘ওয়ান হাউস, ওয়ান মিডিয়া’ চিন্তার পেছনে কূটকৌশল রয়েছে- এটা এখন অনেকেই বলতে শুরু করেছেন। এই কমিশনের সুপারিশমালায় একটি বড় বিজনেস হাউসের প্রচ্ছন্ন প্রভাব রয়েছে। এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বাস্তব অবস্থা সবাই জানেন। কোম্পানির অধীনে সংবাদমাধ্যমকে যুক্ত করার পরামর্শ নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ। কিন্তু বাস্তবের সঙ্গে কোনো মিল নেই। কারণ সংবাদপত্র তো শিল্প হিসেবেই দাঁড়াতে পারেনি। এটা কমিশন সদস্যদের অজানা থাকার কথা নয়। বাংলাদেশে হাতেগোনা কয়েকটি সংবাদপত্র হয়তো যে কোনো পরিস্থিতির মধ্যে টিকে থাকতে পারবে। কারণ তাদের পেছনে বৃহৎ পুঁজির সাপোর্ট রয়েছে। বিশ্বব্যাপী ছাপা পত্রিকা মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখে। বহু বড় বড় পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সংকুচিত হচ্ছে তাদের ব্যবসা। ডিজিটাল যুগে সংবাদমাধ্যম আরেক পরীক্ষার মুখে।  

টেলিভিশনের পরিস্থিতি ভিন্ন। সেখানে তো কোনো বেতন কাঠামোই নেই। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে বিগত সরকার টিভির লাইসেন্স দিয়েছে। এই ধারা এখনো অব্যাহত। আজকের সংবাদমাধ্যমের বেহাল এবং বিতর্কিত অবস্থানের পেছনে টিভি সাংবাদিকদের ‘অবদানই’ খুব বেশি। গুটি কয়েক মানুষের জন্য বিপুলসংখ্যক টিভি সাংবাদিক আজ নিজেদের পরিচয় ভুলতে বসেছেন। নির্বাচন যেহেতু সামনে সেখানে এ ধরনের সুপারিশ কতটা বাস্তবায়নযোগ্য। অতীতের অভিজ্ঞতা হচ্ছে- সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে সব পাল্টে যায়। এবারও যে হবে না এর নিশ্চয়তা কোথায়। অনেকে অবশ্য বলছেন, কমিশনের সুপারিশগুলো অনেকটা পেপারওয়ার্ক হিসেবেই থেকে যাবে। আলোর মুখ দেখবে না। তবে করপোরেট ট্যাক্সের সুপারিশ যথার্থ, বাস্তবসম্মত। রেডিও টেলিভিশন নিয়ে আসাফ্উদ্দৌলাহ্ কমিশন অনেক আগেই ভেবেছিল। দিয়েছিল অনেকগুলো সুপারিশ। কিন্তু কোনো সরকারই সেসব সুপারিশ আমলে নেয়নি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here