বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল যখন আন্তর্জাতিক মানচিত্রে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার জন্য নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে দলটির অভ্যন্তর থেকে প্রকাশ্যে এলো এক ভয়াবহ, অস্বস্তিকর অভিযোগ। ফাস্ট বোলার জাহানারা আলম এবং তার পরপরই সিনিয়র ক্রিকেটার রুমানা আহমেদ সাবেক নির্বাচক মঞ্জুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলায় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) এ নিয়ে এরই মধ্যে তদন্ত শুরু করেছে। বিসিবি’র নারী বিভাগের একটি সূত্র দৈনিক  নিশ্চিত করেছে যে তদন্ত কমিটির কাজ শুরু হয়েছে এবং পুরো বিষয়টি বিসিবি সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল নিজে দেখভাল করছেন। সূত্রটি জানায়, ‘বিষয়টা এতটাই সেনসিটিভ যে এ নিয়ে আমরা কেউ কথা বলতে চাই না তবে এটা বলতে পারি অভিযোগ প্রমাণ হলে কেউ ছাড় পাবে না।’ তারকা খেলোয়াড়দের পক্ষ থেকে সাবেক মঞ্জুরুল ইসলাম নির্বাচক এবং বোর্ডের প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি, অশালীন আচরণ এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের মতো গুরুতর অভিযোগের আঙুল তোলায় দেশের ক্রিকেটাঙ্গনে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। নারী ক্রিকেটারদের এমন ভয়াবহ অভিযোগগুলো বিসিবি আগেই জানতো, কিন্তু সময় থাকতে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। বলার অপেক্ষা রাখে না, বোর্ডের অবহেলাতেই নারী দলে এই ‘নীল বিষ’। এই অভিযোগগুলো কেবল কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনার প্রতিফলন নয়, বরং এটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে বিসিবির দীর্ঘদিনের চরম উদাসীনতাই দলের ভেতরের পরিবেশকে বিষাক্ত করেছে। এটি নিঃসন্দেহে বিসিবির প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং দায়িত্ব জ্ঞানহীনতার চূড়ান্ত প্রমাণ। এই ধরনের পরিস্থিতি দ্রুত সমাধানের জন্য বিসিবিকে তার দায়বদ্ধতা প্রমাণ করতেই হবে, অন্যথায় এর ফল সুদূরপ্রসারী হবে না। প্রাক্তন নির্বাচক মঞ্জুর বিরুদ্ধে জাহানারার অভিযোগ বিশেষভাবে গুরুতর। তিনি দাবি করেছেন, ২০২২ সালের ওডিআই বিশ্বকাপ চলাকালীন ওই নির্বাচক ও তৎকালীন দল ব্যবস্থাপক তার প্রতি অনুপযুক্ত আচরণ করেছেন এবং অশ্লীল প্রশ্ন করেছেন। শুধুমাত্র সাবেক নির্বাচক নন, জাহানারা আলমের অভিযোগের তির বিসিবি’র আরও একাধিক কর্মকর্তার দিকে। তিনি এও জানিয়েছেন যে, তিনি এই বিষয়টি বোর্ডের সাবেক পরিচালক শফিউল ইসলাম নাদেল এবং প্রধান নির্বাহী নিজাম উদ্দিন চৌধুরীকে অবহিত করেছিলেন। প্রশ্ন ওঠে, এত গুরুতর অভিযোগ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানোর পরেও কেন এটি এতদিন চাপা ছিল? কেন নারী দলের মতো একটি সংবেদনশীল বিভাগে এমন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দ্রুত সরিয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি? বিসিবি একটি বিবৃতি প্রকাশ করে জানায় যে তারা অভিযোগগুলো উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করেছে এবং ঘটনাটির পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করেছে, যারা ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবে। কিন্তু এই পদক্ষেপটি এসেছে অভিযোগগুলো গণমাধ্যমে ফাঁস হওয়ার পর, যা বিসিবির ‘সেফ, রেসপেক্টফুল, এবং প্রফেশনাল এনভায়রনমেন্ট’ নিশ্চিত করার অঙ্গীকারকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। জাহানারা আলমের পর যখন রুমানা আহমেদের মতো আরেক সিনিয়র ক্রিকেটার এই অভিযোগের সমর্থনে মুখ খোলেন, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এটি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়, বরং দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা এক বিষাক্ত সংস্কৃতির ফল। এই তদন্ত প্রক্রিয়া নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী, কিন্তু এই ধরনের তদন্ত তখনই শুরু হওয়া উচিত ছিল, যখন অভিযোগগুলো বোর্ডের দপ্তরে প্রথম জমা পড়েছিল। বিসিবির নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তা এই অগ্রহণযোগ্য পরিবেশকে প্রশ্রয় দিয়েছে। সময় থাকতে ব্যবস্থা নিলে হয়তো নারী দলের পরিবেশ এতদূর গড়াতো না। ক্রীড়াঙ্গনে নারী ক্রিকেটারদের জন্য নিরাপদ কর্মক্ষেত্র নিশ্চিত করার পরিবর্তে, বোর্ড শুধুমাত্র অস্বীকার ও কালক্ষেপণ করেই তাদের দায়িত্ব সেরেছে। এর আগে জাহানারা বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক নিগার সুলতানার বিরুদ্ধে শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ তুললেও বোর্ড সেটিকে ‘ভিত্তিহীন’ বলে উড়িয়ে দিয়েছিল। বর্তমান অভিযোগটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির এবং আরও বেশি গুরুতর।
বিসিবির বর্তমান পদক্ষেপকে কেবলই লোক দেখানো বলে মনে হতে পারে, যদি না তারা এই তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না করে। একজন আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেটারের কাছ থেকে আসা যৌন হয়রানির এমন ভয়াবহ অভিযোগ বাংলাদেশের ক্রিকেটের ভাবমূর্তির জন্য চরম বিব্রতকর। বোর্ড যদি সত্যিই নারী ক্রিকেটারদের নিরাপত্তা ও সম্মানের বিষয়ে আন্তরিক হয়, তবে শুধুমাত্র তদন্ত কমিটি গঠন করলেই হবে না, বরং তাদের দীর্ঘদিনের অবহেলার দায় স্বীকার করে দ্রুত, স্বচ্ছ ও কঠিন ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কোনো নারী খেলোয়াড়কে এমন পরিস্থিতি বা অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে না হয়। এই ‘নীল বিষ’ দূর করতে হলে বিসিবিকে তার প্রশাসনিক দৃঢ়তা প্রমাণ করতেই হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here