নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে সপ্তম শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইয়ের একটি অধ্যায়ে ‘শরীফার গল্প’ শিরোনামের লেখা নিয়ে চলছে বিতর্ক। বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন খণ্ডকালীন শিক্ষক এক অনুষ্ঠানে এ নিয়ে বইয়ের পাতা ছিঁড়ে ফেলার পর। ওই ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। চলুন দেখে নেয়া যাক আলোচিত ওই লেখাতে কী রয়েছে।
আমার সম্প্রদায়
খুশি আপা বললেন, আমরা একটা মজার খেলা খেলি চলো! তালিকা থেকে পাওয়া সম্প্রদায়ের বৈশিষ্টট্যগুলো আলাদা আলাদা কাগজে লিখে শ্রেণিকক্ষের বিভিন্ন জায়গায়
সাঁটিয়ে দেওয়া হলো। এবারে খুশি আপা প্রতিবেশীদের নিয়ে শিক্ষার্থীদের যে সম্প্রদায়, সেটির যে বৈশিষ্ট্যটি সবচেয়ে স্পষ্ট করে বোঝা
যায়, প্রত্যকেকে সেখানে গিয়ে দাঁড়াতে বললেন। সবাই বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী দাঁড়িয়ে যাওয়ার পর খুশি আপা হাততালি দিয়ে বললেন, বাহ! আমরা সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্যগুলো চমৎকারভাবে বুঝতে পেরেছি! নিজের সম্প্রদায়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যকেও চিহ্নিত করতে পেরেছি।
নতুন পরিচয়
পরের ক্লাসে খুশি আপা একজন অতিথিকে সঙ্গে নিয়ে এলেন। তিনি বললেন, ইনি ছোটবেলায় তোমাদের স্কুলে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। আজ এসেছেন, নিজের স্কুলটা দেখতে। সুমন জানতে চাইল, আপনার নাম কী?
তিনি বললেন, আমার নাম শরীফা আকতার।
শরীফা
শরীফা বললেন, যখন আমি তোমাদের স্কুলে পড়তাম তখন আমার নাম ছিল শরীফ আহমেদ। আনুচিং অবাক হয়ে বলল, আপনি ছেলে থেকে মেয়ে হলেন কী করে? শরীফা বললেন, আমি তখনও যা ছিলাম এখনও তাই আছি। নামটা কেবল বদলেছি। ওরা শরীফার কথা যেন ঠিকঠাক বুঝতে পারল না।
আনাই তাকে জিজ্ঞেস করল, আপনার বাড়ি কোথায়? শরীফা বললেন, আমার বাড়ি বেশ কাছে।
কিন্তু আমি এখন দূরে থাকি। আনাই মাথা নেড়ে বলল, বুঝেছি, আমার পরিবার যেমন অন্য জায়গা থেকে এখানে এসেছে, আপনার পরিবারও তেমনি এখান থেকে অন্য জায়গায় চলে গিয়েছে। শরীফা বললেন, তা নয়। আমার পরিবার এখানেই আছে। আমি তাদের ছেড়ে দূরে গিয়ে অচেনা মানুষদের সঙ্গে থাকতে শুরু করেছি। এখন সেটাই
আমার পরিবার। তাদের অবাক হতে দেখে শরীফা এবার নিজের জীবনের কথা বলতে শুরু করলেন।
শরীফার গল্প
‘ছোটবেলায় সবাই আমাকে ছেলে বলত। কিন্তু আমি নিজে একসময়ে বুঝলাম, ‘আমার শরীরটা ছেলেদের মতো হলেও আমি মনে মনে একজন মেয়ে। আমি মেয়েদের মতো পোশাক পরতে ভালোবাসতাম। কিন্তু বাড়ির কেউ আমাকে পছন্দের পোশাক কিনে দিতে রাজি হতো না। বোনদের সাজবার জিনিস দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে সাজতাম। ধরা পড়লে বকাঝকা, এমনকি মারও জুটত কপালে। মেয়েদের সঙ্গে খেলতেই আমার বেশি ইচ্ছে করত। কিন্তু মেয়েরা আমাকে খেলায় নিতে চাইত না। ছেলেদের সঙ্গে খেলতে গেলেও তারা আমার কথাবার্তা, চালচলন নিয়ে হাসাহাসি করত। স্কুলের সবাই, পাড়া-পড়শি এমনকি বাড়ির লোকজনও আমাকে ভীষণ অবহেলা করত। আমি কেন এ রকম একথা ভেবে আমার নিজেরও খুব কষ্ট হতো, নিজেকে ভীষণ একা লাগত।
একদিন এমন একজনের সঙ্গে পরিচয় হলো যাকে সমাজের সবাই মেয়ে বলে কিন্তু সে নিজেকে ছেলে বলেই মনে করে। আমার মনে হলো, এই মানুষটাও আমার মতন। সে আমাকে বলল, আমরা নারী বা পুরুষ নই, আমরা হলাম তৃতীয় লিঙ্গ (থার্ড জেন্ডার)। সেই মানুষটা আমাকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে গেল, যেখানে নারী-পুরুষের বাইরে আরও নানা রকমের মানুষ আছেন। তাদের বলা হয় ‘হিজড়া’ জনগোষ্ঠী। তাদের সবাইকে দেখেশুনে রাখেন তাদের ‘গুরু মা’। আমার সেখানে গিয়ে নিজেকে আর একলা লাগল না, মনে হলো না যে আমি সবার চেয়ে আলাদা। সেই মানুষগুলোর কাছেই থেকে গেলাম। এখানকার নিয়ম-কানুন, ভাষা, রীতিনীতি আমাদের বাড়ির চেয়ে অনেক আলাদা। আমরা সবার সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিয়ে একটা পরিবারের মতনই থাকি। বাড়ির লোকজনের জন্যও খুব মন খারাপ হয়। তাই মাঝে মাঝে বাড়িতেও যাই।
আজ থেকে বিশ বছর আগে বাড়ি ছেড়েছি। সেই থেকে আমি আমার নতুন বাড়ির লোকদের সঙ্গে শহরের বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে, নতুন শিশু আর নতুন বর-বউকে দোয়া-আশীর্বাদ করে পয়সা রোজগার করি। কখনো কখনো লোকের কাছে চেয়ে টাকা সংগ্রহ করি। আমাদেরও ইচ্ছে করে সমাজের আর দশটা স্বাভাবিক মানুষের মতো জীবন কাটাতে, পড়াশোনা, চাকরি-ব্যবসা করতে। এখনও বেশির ভাগ মানুষ আমাদের সঙ্গে মিশতে চায় না, যোগ্যতা থাকলেও কাজ দিতে চায় না। তবে আজকাল অনেক মানুষ আমাদের প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল। ইদানীং আমাদের মতো অনেক মানুষ নিজ বাড়িতে থেকে লেখা পড়া করছে।
আমাদের মতো মানুষ পৃথিবীর সব দেশেই আছে। অনেক দেশেই তারা সমাজের বাকি মানুষের মতনই। জীবন কাটায়। তবে আমাদের দেশের অবস্থারও বদল হচ্ছে। ২০১৩ সালে সরকার আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছে। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আমাদের জন্য কাজ করছে। শিক্ষার ব্যবস্থা করছে, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছে। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর প্রচেষ্টা নিচ্ছে। নজরুল ইসলাম ঋতু, শাম্মী রানী চৌধুরী, বিপুল বর্মণের মতো বাংলাদেশের হিজড়া জনগোষ্ঠীর অনেক মানুষ সমাজজীবনে এবং পেশাগত জীবনে সাফল্য পেয়েছেন। ‘
এরপর কর্মক্ষেত্রে সফল কয়েকজন হিজড়ার ছবি দেওয়া হয়েছে বইতে-
এরপর নতুন প্রশ্ন শিরোনামে আরও বলা হয়,
‘ওরা এত দিন জানত, মানুষ ছেলে হয় অথবা মেয়ে হয়। এখানেও যে বৈচিত্র্য থাকতে পারে, সে কথা ওরা কখনো শোনেনি, ভাবেওনি। কিন্তু শরীফা আলাদা রকম বলে সবাই তাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে, এমনকি তার পরিবারের লোকেরাও! শরীফার জীবনকাহিনি শুনে সবার মন এমন বিষাদে ভরে গেল যে তাকে আর বেশি প্রশ্ন করতেও ইচ্ছে করল না।‘
এরপর শিক্ষার্থীদের নিজেদের মধ্যে এ নিয়ে আলোচনা ও নানা প্রশ্নের মাধ্যমে শেখার অংশ রয়েছে-
গণেশ, রনি, আয়েশা, ওমেরা আর নীলা সেদিন বাড়ি ফেরার পথে গল্প করছিল:
গণেশ: তাহলে ছেলে এবং মেয়ে ছাড়াও ভিন্ন রকমের মানুষ হয়।
রনি: আমার মা বলেন, ছোটদের কোনো ছেলেমেয়ে হয় না। বড় হতে হতে তারা ছেলে বা মেয়ে হয়ে ওঠে।
আয়েশা: আমার জানতে ইচ্ছে করছে, আমাদের সময় ছেলে বা মেয়েদের পোশাক, আচরণ, কাজকর্ম যেমন দেখি, প্রাচীন মানুষেরও কি তেমন ছিল? সামনের সময়েও কি এমনটা থাকবে?
রফিক: পৃথিবীর সব দেশে, সকল সম্প্রদায়ে কি ছেলেমেয়ের ধারণা, তাদের চেহারা, আচরণ, সাজপোশাক একই রকম?
নীলা: আমার মা আমাকে বেগম রোকেয়ার লেখা একটা গল্প পড়ে শুনিয়েছিলেন। গল্পটার নাম ‘সুলতানার স্বপ্ন’। সেখানে এমন একটা জায়গা কল্পনা করা হয়েছে যেখানে ছেলে আর মেয়েদের প্রচলিত ভূমিকা উল্টে গিয়েছে।
চলো, আমরাও নারী-পুরুষের ধারণা, সমাজে তাদের ভূমিকা আর নিজেদের ভাবনা সম্পর্কে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করি।