আসছে গ্রীষ্মে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা। গরম না আসতেই কোথাও কোথাও লোডশেডিং করতে হয়েছে। বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হবে গ্রীষ্মে। তখন দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পর্যাপ্ত সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও জ্বালানি সংকটের কারণে চাহিদা মোতাবেক বিদ্যুৎ সরবরাহে বিঘ্ন ঘটতে পারে। ডলার সংকটের কারণে এই খাতের ভোগান্তি আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এদিকে সরকার বিদ্যুতের দাম আরেক দফা বাড়িয়ে টাকার ঘাটতি মেটাতে যাচ্ছে। বাড়ার প্রস্তাবনায় রয়েছে গ্যাসের দামও। ভারতীয় বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল ও জ্বালানি আমদানির জন্য বৈদেশিক মুদ্রা ডলারের জোগানের অনিশ্চয়তা কাটেনি।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রমতে, বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে উৎপাদন সক্ষমতার কোনো ঘাটতি নেই। তবে ঘাটতি আছে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লা, এলএনজি ও জ্বালানি তেলের সরবরাহে। চাহিদামতো জ্বালানি না পাওয়ায় গেল দু’বছর গ্রীষ্ম মৌসুমে ব্যাপক লোডশেডিংয়ে ভুগতে হয়েছে গ্রাহককে। এবার গ্রীষ্ম মৌসুমে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ চাহিদা ধরা হয়েছে প্রায় ১৮ হাজার মেগাওয়াট।
গত বছরের চেয়ে চাহিদা বেড়েছে ১১ শতাংশের মতো। একই সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতাও বেড়েছে একই হারে। তবে গত বছরের মতোই সক্ষমতার বড় একটি অংশ বসিয়ে রাখতে হতে পারে জ্বালানির অভাবে। গত অর্থবছরে পিডিবি ২৬ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ করেছে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া পরিশোধে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলছে, গত বছর ৪১ শতাংশ সক্ষমতা অলস বসে ছিল।
আরইবি সূত্র বলছে, চাহিদার চেয়ে কম সরবরাহ পাওয়ায় লোডশেডিং করতে হচ্ছে। ময়মনসিংহ এলাকায় বেশি এটি। ময়মনসিংহ এলাকার আরইবি’র এক কর্মকর্তা বলেন, এই এলাকায় বিদ্যুতের চাহিদা এখন ৭৫০ থেকে ৮০০ মেগাওয়াট। অল্প কয়েকদিন আগেও ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ লোডশেডিং করতে হয়েছে ময়মনসিংহ এলাকায়। সামনে রমজান ও গরমে চাহিদা ১০০০ মেগাওয়াট হবে। তখন পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা করছেন ওই কর্মকর্তা। আরইবি এখন চাহিদা মোতাবেক বিদ্যুতের সরবরাহ পাচ্ছে কিনা জানতে চাইলে আরইবি’র চেয়ারম্যান অজয় কুমার চক্রবর্তী মানবজমিনকে বলেন, চাহিদা একেক সময় একেক রকম হয়। তবে এ মুহূর্তে টাঙ্গাইলের একটি সভায় থাকায় এর চেয়ে বেশি কথা বলতে পারছি না বলে তিনি উল্লেখ করেন। আগামী গ্রীষ্ম নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে আরইবি ও বাকি পাঁচ বিতরণ সংস্থার কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, গত বছর কোনো কোনো দিন সর্বোচ্চ তিন হাজার মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং করতে হয়েছে। এতে ঢাকায় দুই থেকে তিন ঘণ্টা এবং কোনো কোনো গ্রামাঞ্চলে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎ পায়নি মানুষ।
সাধারণত মার্চ থেকে বিদ্যুৎ চাহিদা বাড়তে থাকে। এটি সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলে। গত বছর সর্বোচ্চ উৎপাদনের সময় গ্যাস থেকে আসে ৬ হাজার ২৫২, জ্বালানি তেল থেকে ৫ হাজার ৫৯৩, কয়লা থেকে ২ হাজার ৬৬৮, জলবিদ্যুৎ থেকে ৭০ ও আমদানি থেকে এসেছে ১ হাজার ৮৫ মেগাওয়াট। গত বছর বিদ্যুৎ সক্ষমতা ছিল ২২ হাজার ৫৬৬ মেগাওয়াট। পাওয়ার সেলের তথ্যমতে, বর্তমানে উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ২৯ হাজার ৭২৭ মেগাওয়াট। বর্তমানে বিদ্যুতের গ্রাহক সংখ্যা ৪ কোটি ৬৪ লাখ। বিদ্যুৎ সুবিধা প্রাপ্ত জনগোষ্ঠী শতভাগ। পিজিসিবি’র গতকাল সন্ধ্যা ৭টার দিকে পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১১ হাজার ২৫০ মেগাওয়াট। ওই সময়ে সর্বোচ্চ উৎপাদন হয় ১২ হাজার ৪২৩ মেগাওয়াট। সর্বনিম্ন উৎপাদন ধরা হয় ৭ হাজার ১৩৩ মেগাওয়াট। রিজার্ভ (উৎপাদন শেষে) ১ হাজার ১৭৩ মেগাওয়াট।
কম দামে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বড় ভরসার স্থান হলো গ্যাস। বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের চাহিদা দিনে প্রায় ২৩২ কোটি ঘনফুট। গত বছর সর্বোচ্চ ১৩০ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত সরবরাহ করা হয়েছে। বর্তমানে সরবরাহ করা হচ্ছে ৮৫ কোটি ঘনফুট। এবার গ্রীষ্মে দিনে অন্তত ১৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস চেয়েছে পিডিবি। যদিও গ্যাস সরবরাহ গত বছরের চেয়ে বাড়ানোর তেমন সুযোগ নেই বলে জানিয়েছে পেট্রোবাংলা সূত্র। এবারও সর্বোচ্চ সাড়ে ৬ হাজার মেগাওয়াট পাওয়া যেতে পারে। উৎপাদন সক্ষমতা আছে প্রায় ১১ হাজার মেগাওয়াট।
গত বছর সাড়ে পাঁচ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে জ্বালানি তেল থেকে। এবার সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন করতে চায় পিডিবি। জ্বালানি তেলে ৭ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট সক্ষমতা আছে। এর জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের বকেয়া শোধের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে ১২ হাজার কোটি টাকার বন্ড ইস্যু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর বাইরে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের আরও প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা বকেয়া আছে। বকেয়ার চাপ ও ডলারের জোগান নিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি তেল আমদানি ব্যাহত হতে পারে।
এবার সবচেয়ে বেশি সুযোগ তৈরি করেছে কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র। গত বছর কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ২ হাজার ৬৯২ মেগাওয়াট। তবে ডলার সংকটে কয়লা আমদানি করা যায়নি। দুই দফায় বন্ধ রাখতে হয়েছে দেশের দুই বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র পায়রা ও রামপাল। এবার আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ কয়লায় সক্ষমতা বেড়ে প্রায় ৬ হাজার মেগাওয়াট হয়েছে। বিশ্ববাজারে কয়লার দাম কম হওয়া সত্ত্বেও কয়লা দিয়ে উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না। দেশের প্রায় সব কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রেরই বিল বকেয়া রয়েছে।
পটুয়াখালীর পায়রা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রটির বিল বকেয়া প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। এ কারণে ছয় মাস বিলম্বে কয়লার বিল দেয়ার সুযোগ থাকার পরও নিয়মিত বিল দিতে পারছে না তারা। কয়লা সরবরাহকারী বিদেশি কোম্পানি সুদসহ বিল পরিশোধের তাগাদা দিয়ে চিঠি দিচ্ছে। চট্টগ্রামের বাঁশখালীর ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত কোনো বিল পরিশোধ করা হয়নি। ২ হাজার কোটি টাকার বেশি বকেয়া রয়েছে। ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের গোড্ডা এলাকায় ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার আদানি বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নিয়মিত সরবরাহ করছে। এ কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাসে বিল গড়ে ৮ থেকে ৯ কোটি ডলার। সেখানেও বকেয়া রয়েছে ।
এ বিষয়ে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ইমরান করিম বলেন, বন্ড ইস্যুর পরও চার থেকে পাঁচ মাসের বিল বকেয়া রয়েছে। আমরা আশা করছি আরেক রাউন্ড বন্ড ইস্যু করে বকেয়া পরিশোধ করবে সরকার। পাশাপাশি ডলার সাপোর্ট দিয়ে সহযোগিতা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাহলে হয়তো লোডশেডিং কিছুটা কম হবে। না হলে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি গত বছরের চেয়ে খারাপ হতে পারে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, সর্বোচ্চ চাহিদা মাথায় রেখেই উৎপাদন পরিকল্পনা করা হয়েছে। জ্বালানির কারণে পরিকল্পনামতো উৎপাদন করা না গেলে লোডশেডিং হতে পারে। তবে বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করা হলে পরিস্থিতি মোকাবিলা করাটা পিডিবি’র জন্য কিছুটা স্বস্তির হবে।