পুতিনের হানিট্র্যাপ। সেখানে সুন্দরী নারীদের দিয়ে প্রলুব্ধ করা হতো পুরুষদের। এরপর তাদেরকে অপহরণ করা হতো। এমনকি হত্যা পর্যন্ত করা হতো। গত তিন বছর ধরে জার্মানিতে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিমানঘাটিতে গুপ্তচরবৃত্তি করছিল তাদের এজেন্টরা। সেখান থেকে পাওয়া তথ্য তারা পাচার করেছে রাশিয়ায়। এখন ধারণা করা হচ্ছে, বৃটেনে রাশিয়ার আরো গুপ্তচর লুকিয়ে আছে। সন্ত্রাস বিরোধী একজন প্রধান কর্মকর্তা সতর্ক করেছেন এ বিষয়ে। কারণ, ক্রেমলিনের জন্য গুপ্তচরবৃত্তি করছিলেন ৬ বুলগেরিয়ান। তাদেরকে সরাসরি নির্দেশনা দেয়া হতো মস্কো থেকে। গুপ্তচরের এই চক্রটি গ্রেট ইয়ারমাউথ গেস্টহাউসে অবস্থান করতো। সেখান থেকে স্পর্শকাতর নজরদারিকারী প্রযুক্তি ব্যবহার করতো তারা।
স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের কমান্ডার ডমিনিক মারফি বলেন, কোনো রাষ্ট্রের মদতে হুমকি মোকাবিলার জন্য বৃটেনের ৫ম সন্ত্রাস বিরোধী পুলিশিং ইউনিট কাজ করছে। রাশিয়ান গোয়েন্দারা যে প্রক্সি এজেন্ট ব্যবজহার করে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে এটা হলো তার মাত্র একটি উদাহরণ। এসব এজেন্টরা ছদ্মবেশে তাদের কর্মকাণ্ড চালাচিছল এবং করছিল স্যাবোটাজ।
অনলাইন ডেইলি মেইলে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সন্ত্রাস বিরোধী কমান্ডের প্রধান ডমিনিক মারফি বলেন, রাশিয়া যে বৃটেনে এভাবে গুপ্তচরবৃত্তি করছে এটি তার একটি ঘটনা। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বেশ কিছু বিঘ্ন সৃষ্টি করা হয়েছে। সেটা আমরা দেখেছি।

তিন মাসের বিচার কার্যক্রমে বিউটিশিয়ান ভান্যয়া গাবেরোভা (৩০), ডেমোরেটর তিহোমির ইভানচেভ (৩৯) এবং ল্যাব টেকনিশিয়ান ক্যাট্রিন ইভানোভা (৩৩)কে রাশিয়ার পক্ষে গুপ্তচরবৃত্থির মাধ্যমে ষড়যন্ত্র করার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। তাদেরকে যারা আশ্রয়প্রশ্রয় দেন তার মধ্যে অরলিন রুসেভ (৪৬), বিসের ডঝামবাজোভ (৪৩) এবং ইভান স্টোয়ানভ (৩২ কে এরই মধ্যে অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্টের অধীনে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে যখন শাস্তি ঘোষণা করা হবে, তখন এসব এজেন্ট দীর্ঘমেয়াদি জেল পেতে পারে।
কিন্তু তারা লন্ডন, ভিয়েনা, ভ্যালেন্সিয়া, মন্টেনেগ্রো এবং স্টাটগার্টসহ বিভিন্ন এলাকায় তাদের অর্থনৈতিক জাল বিস্তার করেছে। তার মধ্যে দু’জন যুবতীকে ধারাবাহিকভাবে ব্যবহার করা হতো হানিট্র্যাপ হিসেবে। আর্থিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য পলাতক ব্যবসায়ী জ্যান মারসালেক, যিনি মস্কোভিত্তিক এদের হোতা, তিনি কমপক্ষে দুই লাখ পাউন্ড পাঠিয়েছেন। টেলিগ্রামে রুসেভের সঙ্গে পরিকল্পনা নিয়ে কমপক্ষে ৮০ হাজার ম্যাসেজ বিনিময় হয়েছে। রুসেভ যে গেস্টহাউসে থাকতেন সেখানে যেন আলাদিনের এক গুহার সন্ধান মিলেছে। সেখানে পাওয়া গেছে স্পর্শকাতর প্রযুক্তি। এর মধ্যে আছে পাথরের ভেতরে লুকানো ক্যামেরা। মোবাইল ফোনে আড়ি পাতার জন্য এক লাখ ২০ হাজার পাউন্ডের একটি ডিভাইস। ১১টি ড্রোন, ২২১টি মোবাইল ফোন এবং ৭৫টি ভুয়া পাসপোর্ট। পাওয়া গেছে কোকোকোলার একটি বোতল। এর ভেতরও লুকানো অবস্থায় রাখা আছে ক্যামেরা।

কমান্ডার মারফি বলেছেন, সন্ত্রাস বিরোধী কর্মকাণ্ডে গত দুই বছরে এত বড় গ্রুপের সন্ধান এই প্রথম পেলেন তিনি। তার কথায়, এসব গোয়েন্দা সরাসরি রাশিয়ার পক্ষে কাজ করছিল। বিষয়টি শুনলে মনে হবে আপনি কোনো উপন্যাস পড়ছেন।
ওই গ্রুপে থাকা দু’জন যুবতীকে বলা হয় শ্যামাঙ্গীনি যমজ। সাংবাদিক ক্রিস্টো গ্রোজেভসক নির্দিষ্ট টার্গেটকে শিকার করতে তাদেরকে বলা হতো হানিট্র্যাপ পাততে।
উল্লেখ্য, সালিসবারিতে স্নায়ুগ্যাস হামলার নেপথ্যে কে তা উদঘাটন করেছিলেন সাংবাদিক ক্রিস্টো গ্রোজেভ। এ জন্য তিনি ক্রেমলিনের টার্গেটে পরিণত হন। তাকে শিকার করতে হানিট্র্যাপ পাতেন গাবারোভা। এর মধ্য দিয়ে ওই সাংবাদিককে যৌনতায় আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেন। এ জন্য তিনি গ্রোজেভকে ফেসবুকে একটি ম্যাসেজ দেন এবং গ্রোজেভ তা গ্রহণ করেন। এরপর মারসালেককে বার্তা পাঠান রুসেভ। তাতে তিনি লেখেন, প্রাপ্তবয়স্কদের একটি ওয়েবসাইটের জন্য আমরা অবশ্যই কিছু একটা ভাল রেকর্ড করতে পারবো। মেয়েটি বাস্তবেই খুব হট। সে যেখানে-সেখানে আসা-যাওয়া করে। স্পাইমাস্টার এ সময় গ্রোজেভকে অপহরণের ষড়যন্ত্র আঁটেন। তাকে অপহরণ করে নিয়ে যেতে চান রাশিয়া। কিন্তু তার সেই পরিকল্পনা বস্তাবায়ন হয়নি।

এই গুপ্তচর চক্র বৃটেনভিত্তিক রাশিয়ার একজন ভিন্নমতাবলম্বিকে টার্গেট করে। তারা তাকে ড্রোন থেকে বিষ মিশানো তীর ছুড়ে হত্যা করার বিষয়ে আলোচনা করে। কাজাখস্তানের সাবেক একজন রাজনীতিক এবং রাশিয়ার একজন আইনজীবীকে তারা জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় মস্কো নেয়ার পরিকল্পনা করে। এর জন্য খরচ ধরা হয় ৩০ হাজার পাউন্ড। এসব এজেন্ট ওই সময় উচ্চ প্রযুক্তির সরঞ্জাম ব্যবহার করে। স্টাটগার্টে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানঘাঁটি প্যাট ব্যারাকে প্রশিক্ষণে ছিলেন ইউক্রেনের কর্মকর্তারা। তাদেরকে শনাক্ত করতে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। এই অপারেশন চালাতে তারা মাসে ৩৪ হাজার পাউন্ড দিতে রাজি হয়।
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে অভিযান চালিয়ে যখন এসব গুপ্তচরকে গ্রেপ্তার করে বৃটিশ পুলিশ, তখন এই অর্থ হয়তো বন্ধ করে দেয় না হয় কর্তন করা হয়। অভিযানে পুলিশ ডঝামবাজোভের ঘরে ঢুকে পড়ে। এসময় বিছানায় গাবারোভার সঙ্গে ডঝামবাজোভকে নগ্ন অবস্থায় দেখতে পায় তারা। এক পর্যায়ে ডঝামবাজোভের দীর্ঘ সময়ের গার্লফ্রেন্ড ইভানোভা পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। তিনি অবশ্য ডঝামবাজোভের সঙ্গে গাবারোভার ওই সম্পর্ক সম্পর্কে জানতেন।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে সালিসবারিতে পয়জন হামলার পর ২৩ জন রাশিয়ান কূটনীতিককে বহিষ্কার করে বৃটেন। তার মধ্যে ছিলেন গোয়েন্দা কর্মকর্তাও। তখন থেকে জাতীয় নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে রাশিয়ার ১০০ কূটনীতিকের ভিসা আবেদন বাতিল করে দেয় বৃটেন।
ওদিকে রাশিয়ার গোয়েন্দা বিয়ক এজেন্সিগুলো তাদের ছদ্মবেশে ষড়যন্ত্র কার্যকর করতে ভিন্ন পদ্ধতি গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে তারা প্রক্সি গ্রুপ সেট করে। এ কথা বলেছেন সন্ত্রাস বিরোধী লেজিসলেশনের নিরপেক্ষ রিভিউয়ার জোনাথন হল কেসি। তিনি বলেন, বিশ্বকে হুমকি দেয়ার জন্য সবচেয়ে ভাল ব্যবস্থা হলো ক্রিমিনাল প্রক্সিদের ব্যবহার। তার ভাষায়, অরলিন রুসেভের ঘটনা আমাদেরকে দেখিয়ে দেয় যে এতে রাশিয়ার খুবই স্পর্শকাতর ‘অ্যাক্টর’রা জড়িত। তারা এসব মানুষের পেছনে নিশ্চয়ই প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেছে। এটা বোঝা যায় তাদের বাসায় পাওয়া জিনিসপত্র দেখে। তাদের এসব কর্মকাণ্ড এমন সময়ে ধরা পড়েছে যখন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে একদিক দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল রাশিয়া। এ সময়ে তারা বৃটেন ও পশ্চিমা মিত্রদের ভেতরে আগ্রাসী গোয়েন্দা তৎপরতা শুরু করে।