ওসমানীর প্রশাসন চালাতেন ‘ব্রাদার’ ঈসরাইল আলী সাদেক। অফিস, অ্যাকাউন্টসহ গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর নিয়ন্ত্রণ করতো তারই লোক। নার্সদের বদলি, পদায়ন সবই ছিল সাদেকের হাতে। এমনকি ওসমানীর প্রশাসনেও ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য। এ কারণে সাদেক যা বলতো ওসমানী’র প্রশাসনও তাই করতো। সাদেকের কথা ছাড়া চুলও নড়েনি হাসপাতালে। ৯ই জানুয়ারি হাসপাতালে গোয়েন্দা অভিযানের পর থেকে পলাতক রয়েছে ব্রাদার সাদেক। ঘুষের ৬ লাখ টাকাসহ গ্রেপ্তার হওয়া তার দুই সহযোগী আমিনুল ও সুুমন রয়েছে কারাগারে। সাদেককে ধরতে একাধিক অভিযান চালালেও তাকে ধরা সম্ভব হয়নি। এ ঘটনার পর থেকে হাসপাতালের দুর্নীতির নানা চিত্র বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে।
তবে এখনো হাসপাতালের অভ্যন্তরে সাদেক সিন্ডিকেটরা সক্রিয়। নানাভাবে ভীতি সৃষ্টি করে তারা নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে। হাসপাতালের প্রশাসনের কর্মকর্তারা এক্ষেত্রে নীরব। সিলেট বিভাগের প্রায় দেড় কোটি মানুষের শীর্ষ চিকিৎসালয় হচ্ছে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। এ হাসপাতালে গোটা বিভাগ থেকেই আসেন রোগীরা। কিন্তু হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতির কাছে অসহায় রয়েছেন রোগীরা। এর প্রতিবাদ করলে হাসপাতালে নানাভাবে রোগীর স্বজনদের হেনস্তার শিকার হতে হতো।
এই হাসপাতালের দুর্নীতি, দলবাজির মহানায়ক ছিল ব্রাদার সাদেক। সে নিজে দায়িত্ব পালন করতো না। সব সময় বসে থাকতো পরিচালক, উপ-পরিচালক কিংবা সহকারী পরিচালকদের রুমে। সেখানে বসেই সে এক হাতে হাসপাতাল নিয়ন্ত্রণ করতো। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সিলেট-১ আসনের এমপি’র নিজের লোক পরিচয় দিয়ে সে এসব করতো। ফলে তার কাছে অসহায় ছিলেন সবাই। এদিকে নানা অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে হাসপাতালের নানা দুর্নীতির চিত্র। এতে দেখা গেছেÑ হাসপাতালের এমন কোনো দপ্তর নেই যেখানে দুর্নীতির ছোঁয়া লাগেনি। ২০১৩ সালে সাদেক হাসপাতালে যোগদানের পর থেকে এসব দুর্নীতির ডালপালা মেলতে থাকে। আগে থেকেই হাসপাতালের নানা শাখা-প্রশাখায় বিচরণ ছিল তার। যোগদান করেই সিন্ডিকেট গড়ে তুলে হাসপাতালের প্রশাসনকে ম্যানেজ করে। নার্সিং শাখা, হিসাব শাখাসহ বিভিন্ন শাখায় নিজের লোক বসিয়ে নিজের কব্জায় নিয়ে নেয়। প্রশাসনের উপ কিংবা সহকারী পরিচালকদের একজন সব সময়ই তার হয়ে কাজ করেছেন। আর নার্সিং শাখার প্রশাসন ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। সিলেট ওসমানী হাসপাতালে প্রায় ৮০০ নার্স কর্মরত রয়েছেন। নার্সরা জানিয়েছেন, নার্সদের পদায়ন, ডিউটি রোস্টার, রাত্রীকালীন ডিউটি (নাইট ডিউটি), নার্সদের বিভিন্ন প্রকারের ছুটি, বদলিসহ বিভিন্ন আবেদন, বদলিসহ বিভিন্ন ছাড়পত্র প্রদানসহ সকল কাজকর্ম তার নিয়ন্ত্রণে চলে। প্রতিজন নার্সের বদলির আবেদনের কাগজপত্র অধিদপ্তরে প্রেরণ করতে হলে তাকে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা দিতে হতো। অন্যথায় বদলির আবেদন অধিদপ্তরে প্রেরণ করা হতো না।
অন্যদিকে অধিদপ্তর হতে নার্সের বদলির আদেশ দিলেও ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা না দিলে বদলির ছাড়পত্র প্রদান করা হয় না। কেউ এর প্রতিবাদ করলে তাকে নানাভাবে হয়রানি করা হতো। অধিকাংশ নার্সই তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিলেন। বিশেষ করে অবিবাহিত নার্সেরা তার কাছে ছিলেন যন্ত্রনার আরেক নাম। অনেক নার্সকে যৌন হয়রানি করা হতো। অনেকেই মুখ খোলেন না। কেউ কেউ মুখ খুললেও পরে নানা হুমকির মধ্যে পড়েন। হাসপাতাল ক্যাম্পাসের ভিতরে ব্রাদার সাদেকের একটি ফার্মেসি ছিল। দুর্ঘটনাকবলিত অর্থোপেডিক্স রোগীদের যন্ত্রাংশ ব্যবসা ওসমানী হাসপাতালে সে এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে রোগীদের কাছ হতে ইচ্ছেমতো দাম আদায় করা হয়। এই ব্যবসায় সহায়তা করেন হাসপাতালের ওটি ইনচার্জ এবং ওয়ার্ডের ইনচার্জ, নার্স, পিয়ন। তাদের কাছে সংরক্ষিত থাকে সাদেকের সকল প্রকার যন্ত্রাংশ। কোন রোগীকে কোন যন্ত্রাংশ (পাত) লাগাবে তা নির্ধারণ করে তার সিন্ডিকেট। রোগীরা বাইরে থেকে পাত কিনে আনলে ওই পাত গ্রহণ হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাত জীবানুমুক্ত না করে এক রোগীর ব্যবহার শেষে ওই পাত অন্য রোগীর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন অজুহাতে নার্সিং কর্মকর্তা, অন্যান্য কর্মচারীদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদাবাজি করে থাকে সাদেক ও তার বাহিনীর সদস্যরা। প্রতি বছর অডিট আসলেই চলে অডিটের নামে চাঁদাবাজি। বিভিন্ন দিবস উদ্যাপনের নামে চলে চাঁদাবাজি।
এ ছাড়া বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের (সংর্বধনা ও শুভেচ্ছার নামে) নাম ভাঙিয়ে, বিভিন্ন সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে, বিভিন্ন দুর্যোগের সময় অসহায় মানুষকে সাহায্যের নাম বলে চাঁদাবাজি করে। নামে-বেনামে ভয় দেখিয়ে চলে চাঁদাবাজি। ২০১৯ সালের ৩রা অক্টোবর রাতে সিলেটের আলমপুর থেকে ১০ বোতল প্যাথিড্রিনসহ র্যাব-৯ আটক করে ব্রাদার সাদেককে। এরপর তাকে স্থানীয় থানায় হস্তান্তর করে র্যাব। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে- ঘুষের ৬ লাখ টাকাসহ দু’জন গ্রেপ্তার এবং সাদেক পলাতকের বিষয়টি জানিয়ে ইতিমধ্যে অধিদপ্তরকে সার্বিক বিষয়ে অবহিত করা হয়েছে। তবে- নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মাকসুরা নুর এনডিসি মানবজমিনকে জানিয়েছেন, ওসমানী হাসপাতালে ঘুষের টাকা দু’নার্সকে গ্রেপ্তার এবং মামলার বিষয়ে তিনি অবগত নন। তাকে কেউ এ ব্যাপারে অবগত করেনি। অভিযোগ পেলে তিনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে জানান।