চিনি দিয়ে শুরু। চোরাই পথে আসা চিনির চালান গায়েব করলেও কোনো অভিযোগ নেই। মাসের পর মাস চিনিবোঝাই ট্রাক ছিনতাই করে সন্ত্রাসীরা। পুলিশও ছিল নির্বিকার। কিন্তু এবার হাত দিয়েছে সবজিবোঝাই গাড়িতেও। মুখোশ পরে অস্ত্রের মুখে ছিনিয়ে নিচ্ছে ট্রাক। কখনো কখনো ট্রাক রেখে সবজি নিয়ে উধাও হয়ে যাচ্ছে তারা। এতে করে গ্রাম থেকে সবজি নিয়ে আসা খামারিরা পড়েছেন লোকসানের মুখে। প্রতিকার চেয়েও পাচ্ছেন না। পরে রোববার সিলেটের জৈন্তাপুরের ১৭ পরগনার মুরুব্বিদের সঙ্গে নিয়ে এসে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে বিষয়টি অবগত করেছেন চাষিরা।
একের পর এক ট্রাক ছিনতাইয়ের ঘটনায় সিলেটের ব্যবসায়ীরাও আতঙ্কে আছেন। ব্যবসায়ী নেতারা জানিয়েছেন, ছাত্রলীগের নাম ধরে মেজরটিলা এলাকার একদল চিহ্নিত সন্ত্রাসী মুখোশ পরে অস্ত্রের মুখে এসব ঘটনা ঘটায়। এখন পর্যন্ত অন্তত ২০টি ট্রাকের সবজি ছিনতাই করা হয়েছে। সিলেটের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার কার্যালয়ে ৫ জন চাষি লিখিতভাবে অভিযোগ জানিয়েছেন।
এরা হচ্ছেন- সিলেটের জৈন্তাপুর এলাকার চাষি কবির আহমদ, হেলাল আহমদ, আব্দুল হান্নান, মজনু মিয়া ও আব্দুর রহিম। চাষিরা জানিয়েছেন- সীমান্ত জনপদ জৈন্তাপুর থেকে আসা সবজিবাহী গাড়িতে এই ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। জৈন্তাপুরের হরিপুর পাড়ি দিয়ে বটেশ্বর এলাকায় গাড়ি এলেই তার পিছু নেয় মোটরসাইকেলে আসা দুর্বৃত্তরা। এরপর সুরমা গেট, শাহপরান, মেজরটিলা, টিলাগড়, শিবগঞ্জ, নাইওরপুল, সুবহানীঘাট পর্যন্ত তারা ট্রাকে থাকা মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। সবজি চাষি ও ব্যবসায়ী জৈন্তাপুরের কবির আহমদ গতকাল বিকালে ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলেন, এবার তার দুটি ট্রাকের মালামাল লুট হয়েছে। ১০-১২টি মোটরসাইকেল নিয়ে আসা অস্ত্রধারীরা শাহপরান এলাকা পাড়ি দেয়ামাত্রই তার গাড়ির গতিরোধ করে। এসময় তারা চালককে ট্রাক থেকে নামিয়ে চাবি নিয়ে নেয় এবং চালককে তাদের সঙ্গে থাকা একটি প্রাইভেটকারের মধ্যে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে বসিয়ে রাখে। এরপর ওই চালকের কাছে ২০-২৫ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে। টাকা না দেয়ায় শেষে গাড়ির সবজি সিএনজি অটোরিকশাসহ অন্যান্য যানবাহনে তুলে নিয়ে যায় তারা। শিবগঞ্জের দাদাপীরের মোকামের কাছে এ ধরনের একটি ঘটনা ঘটানো হয়।
তিনি জানান, পরে টহল পুলিশ নিয়ে এলেও ওদেরকে পাওয়া যায়নি। শনিবার রাতে সবজি ব্যবসায়ী সুলতান মিয়ার একটি সবজিবাহী গাড়ি ছিনতাই করা হয়। নগরের ঝরনার পাড় ওই গাড়ি নিয়ে গিয়ে সবজি লুট করা হয়। সবজি বিক্রেতা হেলাল মিয়া জানিয়েছেন- গত দুই বছর ধরে তাদের সবজি লুট করা হচ্ছে। গাড়িসহ সবজি ছিনতাই করা হচ্ছে। শনিবার রাতেও মেজরটিলা এলাকায় এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। বেশির ভাগ সময় শিমের বিচি বাহী গাড়ি লুট করা হয় বলে জানান তিনি। বলেন, গাড়ি আটকিয়ে ওরা অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে চাঁদা দাবি করে। আর চাঁদা না দিলে সবজি কিংবা গাড়ি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটায়। অজ্ঞাতস্থানে নিয়ে তারা মালামালও লুট করে নিয়ে যায়। প্রতিদিনই তামাবিল রুটে এ ধরনের ঘটনা ঘটানো হচ্ছে বলে জানান তিনি। সিলেট জেলার সুবহানীঘাটের সবজি মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও সিলেট ব্যবসায়ী সমিতির সহ-সভাপতি সাদ মিয়া জানিয়েছেন, ছাত্রলীগের নাম করে একটি সন্ত্রাসী চক্র এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে। রোববার রাতেও সুবহানীঘাটের মন্দির রুট থেকে পিয়াজবাহী একটি ট্রাক ছিনতাই হয়েছে।
তিনি বলেন, গত বছর ধরে লাগাতার ঘটনা ঘটার ফলে আমরা সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী, মেয়র, পুলিশের কাছে বার বার জানিয়েছি। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাচ্ছি না। এতে আমাদের সন্দেহ হচ্ছে ঘটনাকারীদের সঙ্গে টহল পুলিশের যোগাযোগ থাকতে পারে। এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতনদের সহযোগিতা কামনা করেন তিনি। এদিকে স্থানীয়রা জানিয়েছেন, মেজরটিলা ছাত্রলীগের চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের নেতৃত্বে এসব ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। তারা নিজেদের জেলা ছাত্রলীগের নেতা বলে পরিচয় দেয়। সন্ধ্যা নামলেই তারা সশস্ত্র অবস্থায় সুরমাগেট এলাকায় অবস্থান নেয়। এরপর চিনি কিংবা সবজিবাহী ট্রাক এলেই পিছু নেয়। আর সময় সুযোগ বুঝে তারা কখনো গাড়িসহ সবজি, আবার কখনো গাড়ি রেখে সবজি নিয়ে যায়। সুরমাগেট পুলিশ ফাঁড়ি, টিলাগড় পুলিশ পোস্ট ও সুবহানীঘাট ফাঁড়ির পুলিশের যোগসূত্র রয়েছে বলে জানিয়েছেন তারা। দিনের পর দিন এসব ঘটনা ঘটার ফলে এখন ক্ষুব্ধ হচ্ছে ব্যবসায়ীরা।
সিলেটের কালিঘাট এলাকার ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, চিনিবাহী ট্রাক ওই মুখোশপরা সন্ত্রাসীরা প্রথমে ছিনতাই করতো। এনিয়ে ব্যবসায়ীরা পুলিশের কাছে বার বার আবেদন জানালে কোনো কাজ হয়নি। এরপর এখন সবজি, পিয়াজ, রসুনসহ নিত্যপণ্যের মালামালবাহী গাড়িও তারা ছিনিয়ে নিচ্ছে। এতে করে সিলেটে ব্যবসা করাই দায় হয়ে পড়েছে। এনিয়ে গতকাল সিলেটের কালিঘাটের ব্যবসায়ীরা বৈঠক করেছেন। তারা জানিয়েছেন, তারা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিষয়টি অবগত করবেন। এতে যদি কাজ না হয় তাহলে তারা কর্মসূচিতে যাবেন।
এ ব্যাপারে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া কর্মকর্তা, এডিসি সাইফুল ইসলাম জানিয়েছেন, এ ধরনের অভিযোগ গুরুতর। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। যারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকবে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে বলে জানান তিনি। জৈন্তাপুরের ১৭ পরগনার নেতারা জানিয়েছেন, আমরা বিষয়টি সিলেটের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে অবগত করেছি। এ ব্যাপারে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। তারা কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছেন। এখন আমরা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছি। পরবর্তীতে এনিয়ে সিদ্ধান্ত জানানো হবে বলে জানিয়েছেন তারা।