অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে পশ্চিম জাপানের হায়োগো প্রদেশের তাকাসাগো শহরের একটি পারিবারিক কসাইয়ের দোকান আসাহিয়া থেকে হিমায়িত কোবে গরুর ক্রোকেটের একটি বাক্স অর্ডার করলে সেটি পেতে ৪৩ বছর অপেক্ষা করতে হবে। খবর সিএনএন এর।
জানা গেছে, ১৯২৬ সালে প্রতিষ্ঠিত আসাহিয়া আগে কয়েক দশক ধরে হায়োগো প্রদেশের মাংসের পণ্য বিক্রি করত। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের বছরগুলোতে গরুর মাংসের ক্রোকেট বিক্রি করা শুরু করে। ২০০০-এর দশকের গোড়ার দিকে এই ভাজা আলু এবং গরুর মাংসের ডাম্পলিং প্রথম ইন্টারনেটের মাধ্যমে পরিচিতি পায়। এর পরিচিতি বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতারা এখন বিরক্তিকর দীর্ঘ অপেক্ষার সম্মুখীন হন।
একটি অলাভজনক ব্যবসায়িক বুদ্ধি
আসাহিয়া যেই চার ধরনের কোবে গরুর ক্রোকেট বিক্রি করে তার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ‘এক্সট্রিম ক্রোকেটস’। দোকানটিতে ‘প্রিমিয়ার কোবে বিফ ক্রোকেট’ পাওয়ার জন্য বর্তমানে চার বছরের অপেক্ষা তালিকা রয়েছে।
আসাহিয়ার তৃতীয় প্রজন্মের মালিক শিগেরু নিত্তা বলেন, “আমরা ১৯৯৯ সালে অনলাইন শপিংয়ের মাধ্যমে আমাদের পণ্য বিক্রি শুরু করি। সেই সময়ে আমরা শুরুতে কেমন সাড়া পাবো সেটা জানার জন্য ‘এক্সট্রিম ক্রোকেটস’ বিক্রি করা শুরু করেছিলাম।”
তিনি ১৯৯৪ সালে ৩০ বছর বয়সে তার বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে দোকানটির মালিক হন।
কয়েক বছর ধরে ই-কমার্স নিয়ে পরীক্ষা করার পর তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে গ্রাহকরা অনলাইনে প্রাইম বিফের জন্য মোটা অঙ্কের অর্থ দিতে দ্বিধাবোধ করছেন। তখনই তিনি এই সাহসী সিদ্ধান্ত নেন।
নিত্তা বলেন, “আমরা ‘এক্সট্রিম ক্রোকেটস’ বিক্রি করেছি প্রতি পিস ২৭০ জাপানিজ ইয়েন (১.৮০ মার্কিন ডলার) করে যেখানে এটি বানানোর জন্য ব্যবহৃত গরুর মাংসের দামই ছিল প্রতি পিস ৪০০ জাপানিজ ইয়েন (২.৭০ মার্কিন ডলার)।”
শুরুতে আর্থিক ক্ষতি সীমিত করার জন্য আসাহিয়া প্রতি সপ্তাহে মাত্র ২০০ ক্রোকেট বিক্রি করতো।
নিত্তার দাদা নিজেই হাতে ঠেলাগাড়ি নিয়ে হায়োগোর আরেকটি বিখ্যাত ওয়াগিউ-প্রজনন এলাকা সান্দায় বাইক নিয়ে গিয়ে গরুর মাংস নিয়ে আসতেন।
নিত্তা যোগ করেন, “সেই সময় থেকেই আমাদের দোকানের সাথে স্থানীয় গরুর মাংস উৎপাদনকারীদের যোগাযোগ ছিল। তাই আমাদের প্রদেশের বাইরে থেকে কোন পণ্য আনতে হয়নি।”
উৎপাদন ও জনপ্রিয়তা দুটোই বেড়েছে
এক্সট্রিম ক্রোকেটসের দাম কম হলেও এটি তৈরিতে ব্যবহৃত উপাদানের গুণমানে অনেক বেশী। উপাদানগুলো তাজা এবং কোনো ধরনের কৃত্রিম কিছুই ব্যবহার করা হয় না। উপাদানগুলির মধ্যে রয়েছে তিন বছর বয়সী ‘এ৫-র্যাংকড’ কোবে গরুর মাংস এবং স্থানীয় খামার থেকে সরবরাহকৃত আলু।
নিত্তা বলেন, তিনি আলু চাষে সার হিসেবে গরুর গোবর ব্যবহার করতে খামারিদের উৎসাহিত করেছেন। আলুর ডালপালা তারপর আবার গরুকে খাওয়ানো হয়।
অবশেষে তার এই বুদ্ধি স্থানীয়দের এবং মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ২০০০-এর দশকের গোড়ার দিকে যখন আসাহিয়ার ক্রোকেট সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল তখন তাদের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী হয়ে যায়।
২০১৬ সালে এক্সট্রিম ক্রোকেট বিক্রি করা বন্ধ করে দেয় আসাহিয়া কারণ গ্রাহকদের ১৪ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হত। এই ব্যাপারে নিত্তা বলেন, “আমরা অর্ডার নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম কিন্তু আমাদের ফোন করে এক্সট্রিম ক্রোকেট বিক্রি বন্ধ না করার জন্য অনুরোধ করা হয়।”
এখন সপ্তাহে ২০০ ক্রোকেটের পরিবর্তে প্রতিদিন ২০০ ক্রোকেট তৈরি করছে আসাহিয়া।
নিত্তা জানান, “বাস্তবে এক্সট্রিম ক্রোকেটগুলি অন্যান্য পণ্যের তুলনায় অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়েছে।”
নিত্তার ভাষ্যমতে, প্রায় অর্ধেক লোক যারা ক্রোকেট খায় তারা আসাহিয়ার কাছে কোবে গরুর মাংসের অর্ডার দেয় যেটি মাংস বিক্রির একটি ভালো কৌশল।
ক্রোকেট বিক্রির উদ্দেশ্য
এক্সট্রিম ক্রোকেটসের প্রতিটি বাক্স (যার মধ্যে পাঁচ পিস ক্রোকেট থাকে) বর্তমানে ২৭৫০ জাপানিজ ইয়েনে (১৮.২০ মার্কিন ডলার) বিক্রি হয়।
শিপিং অনুমানের উপর ভিত্তি করে আসাহিয়া অপেক্ষারত গ্রাহকদের নিয়মিত চিঠি পাঠায় কবে তারা ক্রোকেট পেতে পারে সেটি জানানোর জন্য।
ডেলিভারির এক সপ্তাহ আগে দোকানটি আবার অপেক্ষারত গ্রাহকদের ডেলিভারির তারিখ নিশ্চিত করে।
বর্তমানের ক্রোকেট পাওয়া গ্রাহকরা প্রায় ১০ বছর আগে তাদের অর্ডার দিয়েছিলেন। ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ‘লাইনে অপেক্ষারত’ আছেন ৬৩ হাজার লোক।
অলাভজনক অর্ডারের ৪০ বছরের তালিকা পূরণ করা আসাহিয়ার জন্য বাড়তি চাপ যেহেতু কোবে গরুর মাংসের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি এটি তৈরি করাও বেশ পরিশ্রমের কাজ।
কিন্তু কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিত্তাকে ক্রোকেট বিক্রি চালিয়ে যেতে উৎসাহিত করেছে।
তিনি বলেন, “যখন আমি ইন্টারনেটে ক্রোকেট বিক্রি শুরু করি তখন প্রত্যন্ত বিচ্ছিন্ন দ্বীপ থেকে অনেক অর্ডার পাই। সেখানকার অনেকেই টিভিতে কোবে গরুর মাংসের কথা শুনেছিল কিন্তু কখনো খায়নি কারণ কোবে গরুর মাংস কেনার জন্য তাদের শহরে যেতে হবে। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে এমন অনেক লোক আছে যারা কখনই কোবে গরুর মাংস খায়নি।”
সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্তগুলির মধ্যে একটি হল, ক্যান্সার রোগীর কাছ থেকে এক্সট্রিম ক্রোকেটের অর্ডার পাওয়া।
নিত্তা বলেন, “আমি শুনেছি যে আমাদের ক্রোকেটগুলি ঐ রোগীর অস্ত্রোপচার করার প্রেরণা ছিল। এটা আমাকে সবচেয়ে বেশি অবাক করেছিল।”
রোগীটি শেষ পর্যন্ত বেঁচে যান এবং তারপর থেকে এখন পর্যন্ত একাধিক ক্রোকেটের অর্ডার দিয়েছেন।
আরও বেশি লোককে কোবে গরুর মাংস উপভোগ করতে দিয়ে তিনি আশা করেন যে, এই ক্রোকেটগুলির খ্যাতি স্থানীয় শিল্পের উন্নতিতে সাহায্য করবে৷
অপেক্ষা করতে না চাইলে কী করবেন?
আসাহিয়ার এখন দুটি দোকান রয়েছে। তাদের আসল দোকান তাকাসাগো শহরে অবস্থিত এবং কোবে শহরে রয়েছে আরেকটি দোকান৷ এর হিমায়িত গরুর মাংসের ক্রোকেটগুলি শুধু দেশেই ডেলিভারি দেওয়া হয়।
যদিও আসাহিয়া প্রাথমিকভাবে কসাই এর দোকান, নিত্তা বলেন, পর্যটক অথবা গ্রাহকরা তাদের কোবের দোকানে যেতে পারেন। সেখানে ‘টর রোড’ এবং ‘কিতানোজাকা’ নামে দুই ধরনের ক্রোকেট তৈরি করা হয় যেগুলো তারা কিনে খেতে পারবেন। ক্রোকেটগুলোর নাম কোবের দোকানের কাছাকাছি রাস্তার নামানুসারে দেওয়া হয়েছে।
‘কিটানোজাকা’ চর্বিহীন গরুর মাংস ব্যবহার করে তৈরি করা হয় এবং প্রতিটির দাম ৩৬০ জাপানিজ ইয়েন (২.৪০ মার্কিন ডলার)। ‘টর রোড’ গরুর কটিদেশের মাংস এবং উপরের কাঁধ অথবা নীচের ঘাড়ের মাংস ব্যবহার করে তৈরি করা হয় যার দাম প্রতি পিস ৪৬০ জাপানিজ ইয়েন (৩.১০ মার্কিন ডলার)। -দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড