সরকারের রাজস্ব আদায় কমে যাওয়ায় খরচ মেটাতে ঋণের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে সরকারের অভ্যন্তরীণ উৎসের পুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ ছিল ৭ লাখ ১৪ হাজার ৮৩১ কোটি টাকা। গত বছরের একই মাসে যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ১৬ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই সময়ের মধ্যে দেশের ব্যাংক ও নন-ব্যাংকিং উৎস থেকে সরকারের পুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ বেড়েছে এক লাখ ১ হাজার ৯২৬ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
সরকার বিল-বন্ড ও সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণ নেয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ও তফসিলি ব্যাংক থেকে সরকারের নেয়া সরাসরি ঋণই হলো ব্যাংক খাতের ঋণ। প্রায় এক বছর ধরে দেশে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি বজায় রয়েছে। এর প্রভাবে ২০২৩ সালের জুলাই থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারকে ঋণ দেয়া কমিয়ে দিয়েছে।
তথ্য মতে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে সরকার মোট ৯ হাজার ৮০৬ কোটি টাকা ঋণ করেছে। এর মধ্যে সরকার সঞ্চয়পত্রের আসল বাবদ ৩ হাজার ৮৫৯ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছে। ফলে ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে সরকারের প্রকৃত ঋণ কমে ৫ হাজার ৯৪৭ কোটি টাকায় নেমেছে।
এদিকে গত নভেম্বর শেষে ব্যাংক থেকে নেয়া সরকারের পুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ লাখ ৮৯ হাজার ৫০১ কোটি টাকা। আর ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে নেয়া পুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ লাখ ২৭ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই-নভেম্বরে সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য তফসিলি ব্যাংক থেকে সরাসরি ঋণ নিয়েছে ৩ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা।
আগের অর্থবছরের একই সময়ে ব্যাংকে সরকারের প্রকৃত ঋণ ছিল ৩২ হাজার কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ কিছুটা কম নিলেও ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে এ খাত থেকে সরকারের প্রকৃত ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৯৪৭ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা।
সদ্য সমাপ্ত বছরের শুরু থেকে দেশে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি বজায় রয়েছে। মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতির সময়ে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেয়া বাড়লে পরোক্ষভাবে তা মূল্যস্ফীতিকে আরও বাড়িয়ে দেয়। এ কারণে অর্থনীতিবিদরা ব্যাংক খাত থেকে সরকারকে ঋণ না দিতে পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারকে ঋণ দেয়া বন্ধ করে দেয়।
বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, সরকার বর্তমানে বাণিজ্যিক ব্যাংগুলো থেকে ঋণ নিচ্ছে বেশি। এখান থেকে ঋণ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে পরিশোধ করছে। মূল্যস্ফীতিতে এর প্রভাব কিছুটা হলেও পড়বে। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে মূল্যস্ফীতিতে বড় কোনো প্রভাব পড়ে না।
তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ২৭ হাজার ৯৫২ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। পাশাপাশি এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংককে ৩৪ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। ২০২২ সালের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের নিট ঋণ ছিল ২৬ হাজার ৯৭ কোটি টাকা। কিন্তু মঙ্গলবার (৩০ জানুয়ারি) যে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে, সেটি জুলাই-নভেম্বর সময়কালের।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। এ কারণে সীমিত আয়ের মানুষকে জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে হিমশিম খেতে হয়। ফলে মানুষ আগের মতো সঞ্চয় করতে পারছে না। অনেকে আগের সঞ্চয় ভেঙ্গে ব্যয় করে ফেলছে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছে। এর মধ্যে ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা এবং ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে ২৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার কথা। ব্যাংকবহির্ভূত খাতের মধ্যে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ১৮ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার।