ইসলামের প্রথম চার খলিফাকে খুলাফায়ে রাশিদীন বা রাশিদুন খলিফা বলা হয় । ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে রাসুল (সাঃ) এর ওফাতের পর থেকে ৬৬১ সাল পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে হযরত আবু বকর (রাঃ) , হযরত ওমর (রাঃ) , হযরত ওসমান (রাঃ) , হযরত আলী (রাঃ) খেলাফতের দায়িত্ব পালন করেন । এঁরাই রাশিদুন খলিফা হিসেবে পরিচিত । ‘রাশিদুন’ অর্থ হচ্ছে সঠিকভাবে জীবন-বিধান পালনকারী।
হযরত আবু বকর (রাঃ) এর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব সামনে আনতে গেলে বলতে হয় , তিনি ইসলামী দুনিয়াকে ভাঙনের হাত থেকে এবং নকল নবীদের হাত থেকে রক্ষা করেন । হযরত ওমর (রাঃ) এর সময়ে মুসলিম জাহানের প্রসার ঘটে । হযরত ওসমান (রাঃ) পবিত্র কোরানের লিখিত ভার্সান সঠিকভাবে সংরক্ষণ করেন । হযরত আলী (রাঃ) এর মাঝে একজন সেনাপতি এবং জ্ঞানী শাসকের মেলবন্ধন ঘটে ।
চার জন খলিফার মধ্যে হযরত ওসমান (রাঃ) এর শাসনকালীন ১২ বছর সময়ের শেষ কয়েক বছরে কিছু শাসনতান্ত্রিক দুর্বলতার লক্ষণ দেখা যায় । অতি বৃদ্ধ বয়সের কারণে তিনি তখন কঠোর হাতে শাসন করতে কিছুটা ব্যর্থ হন । এছাড়া সকলেই যার যার শাসনাধীন সময়ে দক্ষ, জনকল্যাণ্মুখি এবং জ্ঞানভিত্তিক উদার শাসনের প্রমাণ রেখেছেন । চারজন খলিফা-ই তাদের সময়ে শাসক হিসেবে সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি ছিলেন , এ কথা প্রমাণের প্রধান যুক্তি হচ্ছে যে , রাসুল (সঃ) এর ওফাতের পর থেকেই এই চারজন নেতা প্রতিবার নির্বাচক মন্ডলীর কাছে পার্থী হিসেবে বিবেচিত হতেন ।
সর্বকনিষ্ঠ হলেও হযরত আলী (রাঃ) প্রথম তিন বারই খলিফা পদের প্রস্তাবিত দাবিদার ছিলেন এবং চতুর্থ বার তিনি খলিফা মনোনীত হন ।
রাশিদুন অভিধার যুক্তিসংগত তাৎপর্য খলিফাদের শাসন ব্যবস্থা এবং যাপিত জীবনে পাওয়া যায় । হযরত আবু বকর (রাঃ) মিশর অভিযানের সময়ে তার সেনাপতিকে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং ফসলের ক্ষেত ধ্বংস না করা-সহ অন্য যেসব নির্দেশ দিয়েছিলেন , তাকে বর্তমান সময়ের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নীতির সাথে তুলনা করা যায় । মিসরের ভাবী গভর্নর মালিক ইবনে হারিস আশতারিকে লেখা হযরত আলী (রাঃ) এর পত্র এখনো শাসকদের জন্য অনুসরণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়। ইসলামিক ফাউন্ডেশন , বাংলাদেশ কর্তৃক প্রচারিত পত্রের আংশিক ভাষ্য নিচে উধৃত করা হলো :
“ তুমি মনে রাখবে মালিক, এ মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগী শ্রেণি হচ্ছে মানব সমাজের আবর্জনা। তারা হচ্ছে এমন সব লোক যারা (১) সমৃদ্ধির সময় রাষ্ট্রের উপর সবচেয়ে বড় বোঝা, (২) অভাব ও সংকটের সময় তারা সবচেয়ে কম উপকারী, (৩) তারা সাম্য-ন্যায়কে সবচেয়ে বেশি ভয় পায়, (৪) রাষ্ট্রীয় সম্পদে তাদের দাবির ব্যাপারে তারা সবচেয়ে নাছোড়াবান্দা, (৫) তারা কখনই প্রদত্ত অনুগ্রহে তৃপ্ত নয়, (৬) সমস্ত অনুগ্রহের ব্যাপারেই তারা সবচেয়ে অকৃতজ্ঞ, (৭) যখন তাদের দাবিগুলো যথার্থভাবেই অগ্রাহ্য করা হয় , তখন তারা এর পেছনে যুক্তিগুলো মেনে নিতে সবচেয়ে নিষ্পৃহ ও অনাগ্রহী, (৮) আর যখন সময় ও ভাগ্য পরিবর্তিত হয় তখন তাদেরকে তাদের বিশ্বাসের উপর মোটেও স্থির থাকতে দেখা যায় না, (৯) সমাজের সম্পদগুলোর জন্য তারা হচ্ছে সবচেয়ে বড় নর্দমা। এ সমস্ত লোকের বিপরীতে সাধারণ মানুষ, দরিদ্র ও কম সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণি হচ্ছে ইসলামের খুঁটি। তারা হচ্ছে মুসলিম সমাজের আসল শক্তি। ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে তারা সদা সতর্ক সৈনিক হিসেবে কাজ করে। সুতরাং তাদের প্রতি তোমার মনের দুয়ার খুলে দাও, তাদের সাথে আরো বন্ধুভাবাপন্ন হও এবং তাদের সহানুভূতি ও আস্থা অর্জন কর।“
হযরত ওমর ( রাঃ) এর ন্যায় বিচার এবং আইনের শাসনের প্রতি কঠোরতা আজও দৃষ্টান্ত হিসেবে স্মরণ করা হয় । শাস্তি প্রদানে তিনি তার নিজের সন্তানকেও রেহাই দেননি। তিনি মদপানের শাস্তিস্বরূপ ৮০টি বেত্রাঘাত করেন ছেলেকে। বেত্রাঘাতের ফলে ছেলে অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং কয়েক দিনের মধ্যে ইন্তেকাল করে। বর্তমান পৃথিবীতে সুবিচারের এমন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তার মহানুভবতার প্রমাণ হিসেবে পালা করে দাসের সাথে উটের পিঠে সওয়ার হওয়ার কাহিনী তো কমবেশি সবাই আমরা জানি । হযরত ওসমান (রাঃ) এর অতি সাধারণ জীবনযাপন এবং ইসলামের জন্য অকাতরে দান করার কথা ইতিহাসে সুবিদিত । মদিনায় মুসলিমদের অবস্থানের প্রথমদিকে পানীয় জলের অভাব ছিল । একজন ইহুদী ব্যক্তির একটা কুয়া ছিল, যার পানি চড়াদামে বিক্রয় করা হতো । হযরত ওসমান (রাঃ) নিজের অর্থে সে কুয়া কিনে নিয়ে তার পানি সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন । খলিফা হওয়ার পর তার ব্যবসায়ে ভাটা পড়ে , কারণ রাষ্ট্রের কাজে সময় দিতে গিয়ে ব্যবসায়ের কাজ থেকে তাঁকে সরে আসতে হয় । তখন খলিফার জন্য বরাদ্দ করা বায়তুলমাল এর সামান্য অর্থ দিয়ে তিনি অতি সাধারণভাবে সংসার চালাতেন ।
খুলাফায়ে রাশিদুনের চার জন খলিফাই রাসুল (সঃ) এর নিকট আত্মীয় ছিলেন এবং অতি নিকট থেকে তাঁকে দেখেছেন । হযরত আবু বকর (রাঃ) এবং ওমর (রাঃ) রাসুল (সঃ) এর শ্বশুর ছিলেন । হযরত ওসমান (রাঃ) এবং আলী (রাঃ) ছিলেন রাসুলের জামাতা । রাসুল (সঃ) অপেক্ষা ৩০ বছরের ছোট হলেও হযরত আলী (রা) রাসুলের সাথে একই পরিবারে বড় হয়েছেন ; অন্য তিন খলিফা রাসুলের কাছাকাছি বয়সের ছিলেন। হযরত আবু বকর (রাঃ) রাসুল (সঃ) এর চেয়ে তিন বছরের ছোট ছিলেন। হযরত ওমর (রাঃ) রাসুল (সঃ) অপেক্ষা ১২ বছরের এবং ওসমান (রাঃ) রাসুল (সঃ) অপেক্ষা ছয় বছরের ছোট ছিলেন । তারা রাসুল (সঃ) এর ঘনিষ্ঠ সাহাবী ছিলেন এবং সকলেই মদিনায় হিযরত করেছিলেন । খলিফাদের চার জনই কুরায়েশ বংশের সন্তান । হযরত আবু বকর (রাঃ) ব্যতীত অন্য তিনজনই আততায়ীর হাতে শাহাদত বরণ করেন । তারা রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তি হয়েও নিজস্ব আত্মরক্ষার চিন্তা নিয়ে ততটা উদ্গ্রীব ছিলেন না , যতটা একাগ্রভাবে নিবেদিত ছিলেন রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালনে । সেই সুযোগটা নিয়েছিল পথভ্রষ্ট আততায়ীরা । হযরত ওসমান (রাঃ) এর ৮০/৮১ বছরের দীর্ঘ জীবন লাভের ঘটনা ছাড়া বাকি তিন খলিফাই ৬১ অথবা ৬২ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন বা নিহত হন । উল্লেখ্য যে তাদের জীবন রাসুল (সঃ) এর ৬২ বছরের জীবনের থেকে দীর্ঘ নয় । এই তিন জনই যথেষ্ট শক্তিসামর্থ্য এবং কর্মক্ষম অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন । সব দিক বিবেচনায় , খুলাফায়ে রাশিদীন বা রাশিদুন অভিধা ইসলামের প্রথম চার খলিফা উপযুক্তভাবে প্রমাণ করে গেছেন ।
( গাজী মিজানুর রহমান , লেখক ও প্রবন্ধকার )