সর্বশেষ
Home » ধর্ম » বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাত আজ

বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাত আজ

তাবলীগ জামাতের শীর্ষ মুরুব্বিদের গুরুত্বপূর্ণ বয়ান ও জিকির আসগারের মধ্যদিয়ে শনিবার বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় দিন অতিবাহিত হয়েছে। আজ রোববার সকাল ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে যেকোনো সময় আখেরি মোনাজাতের মধ্যদিয়ে শেষ হচ্ছে তিন দিনব্যাপী বিশ্ব ইজতেমার। আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করার কথা রয়েছে কাকরাইল জামে মসজিদের পেশ ইমাম ও খতিব হাফেজ মাওলানা জুবায়ের আহমেদের। তাবলীগের ৬ উসূলের (মৌলিক বিষয়ে) উপর গতকাল বাদ ফজর ভারতের মাওলানা আব্দুর রহমানের বয়ানের মধ্যদিয়ে দ্বিতীয় দিনের বয়ান শুরু হয়। বাদ জোহর বয়ান করেন ভারতের মাওলানা ইসমাইল গোধরা। বাদ আসর বয়ান করেন ভারতের মাওলানা জুহাইরুল হাছান। বাদ মাগরিব বয়ান করেন ভারতের মাওলানা ইব্রাহীম দেওলা।
শীত-বৃষ্টিসহ বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে বিশ্ব ইজতেমা এলাকায় লাখ লাখ মুসল্লির পদভারে মুখরিত হয়ে উঠেছে। শিল্প নগরী টঙ্গী এখন যেন ধর্মীয় নগরীতে পরিণত হয়েছে। আজ আখেরি মোনাজাতের আগ পর্যন্ত মানুষের স্রোত অব্যাহত থাকবে টঙ্গীমুখো।ইতিমধ্যে ইজতেমা ময়দান কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেছে গত বৃহস্পতিবার থেকে। মূল প্যান্ডেলে স্থান না পেয়ে হাজার হাজার মুসল্লি নিজ উদ্যোগেই প্যান্ডেলের বাইরে ময়দানে প্রবেশের রাস্তাগুলোতে পলিথিন সিট ও কাপড়ের শামিয়ানা টানিয়ে অবস্থান নিয়েছেন।
এবার ইজতেমা ময়দানে যৌতুকবিহীন বিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশ্ব ইজতেমার মিডিয়া সেলের সমন্বয়কারী হাবিবুল্লাহ রায়হান।
গতকাল সকালের মুসল্লিদেরকে অধিক মনোযোগ সহকারে মুরুব্বিদের মূল্যবান বয়ান শুনতে দেখা গেছে।
মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে বয়ান: গতকাল বাদ ফজর ভারতের মাওলানা আব্দুর রহমান ইমান, আমল, জাহান্নাম, জান্নাত ও দাওয়াতে মেহনতের ওপর গুরুত্বপূর্ণ বয়ান রাখেন। তিনি বলেন, আমাদের জানমাল দ্বীনের দাওয়াতের কাজে ব্যয় করতে হবে। ঘর তৈরি করতে গেলে যে পরিমাণ মেহনত করা প্রয়োজন, আমরা সে পরিমাণ মেহনত করলে একটি ঘর তৈরি হয়। ঠিক একইভাবে দাওয়াতের কাজে যে পরিমাণ মেহনত করা প্রয়োজন, সে পরিমাণ মেহনত করলে আল্লাহতায়ালা আমাদের দাওয়াতকে কবুল করবেন। আর দাওয়াত কবুল হলে আমাদের দোয়া কবুল হবে। দোয়া কবুল হলে আমাদের জীবন পরিবর্তন হয়ে যাবে। বয়ানে তাবলীগ মুরুব্বিগণ বলেন, আল্লাহতায়ালা আপনাকে আমাকে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন এবং আল্লাহতায়ালা এটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, দুনিয়াতে যে একবার আসবে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। আল্লাহ পাকের এ সিদ্ধান্তের কোনো পরিবর্তন হবে না। কারণ তিনি কোরআন পাকে বলে দিয়েছেন যে, পৃথিবীতে যত কিছু আছে তা সব কিছুই একদিন শেষ হয়ে যাবে। প্রকাশ্যে যা কিছু হয় তা তিনি দেখতে পারেন আর গোপনে যা কিছু হয় তাও তিনি দেখতে পাচ্ছেন। আল্লাহ পাকের দৃষ্টির বাইরে একটা অণু বা একটা র্জারাও নেই। দুনিয়া হচ্ছে ধোঁকার ঘর, এ দুনিয়া হচ্ছে ধোঁকার জীবন। দুনিয়ার জীবন ধোঁকার জীবন।
বয়ানে বলা হয়, উম্মতকে যে জিম্মাদারি দেয়া হয়েছে তার মূল্য সাহাবায়ে আজমাঈন বুঝতেন। তাই তারা সর্বদিকে এই দাওয়াতের জিম্মাদারি পৌঁছে দেয়ার জন্য পূর্ব-পশ্চিম ও উত্তর-দক্ষিণসহ সারা দুনিয়ার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়তেন। সাহাবায়ে আজমাঈনগণ তাদের জান ও মাল দাওয়াতের কাজে ব্যবহার করতেন। তাই আল্লাহজাল্লাহ শানহু প্রতি কদমে কদমে তাদের সাহায্য করতেন। আল্লাহ তাদের দেশের পর দেশ জয় করে দিয়েছেন। যেদিকে তারা মেহনত করেছেন আল্লাহতায়ালা সেদিকে হেদায়েত পৌঁছে দিয়েছেন; যেদিকে উনাদের জান ও মাল লাগিয়েছেন সেদিক আল্লাহতায়ালা দুনিয়ার মধ্যে হেদায়েতকে সহজ করে দিয়েছেন। দুনিয়া ও আখেরাতে মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো ঈমান এবং আমল। ঈমান ও আমল দ্বারাই দুনিয়া ও আখেরাতে কামিয়াবি হাসিল হয়। আল্লাহর কাছে ইসলাম ছাড়া অন্য কিছু গ্রহণযোগ্য না। ইসলামই আল্লাহপাকের নিকট একমাত্র মনোনীত দ্বীন এবং রাস্তা। আল্লাহর মনোনীত দ্বীন ইসলাম শুধু আমাদের জন্য না এটা পুরো দুনিয়ার মানবজাতির জন্য। সেজন্য ইসলামকে শুধু আমাদের মধ্যে রাখলে জিম্মাদারি আদায় হবে না। ইসলামকে সারা দুনিয়ায় মানুষের মাঝে পৌঁছানো দরকার। তিনি বলেন, যার কাছে ধনসম্পদ নেই, আমরা তাকে মিসকিন বা ফকির বলি। কিন্তু প্রকৃত মিসকিন বা ফকির হলো সেই ব্যক্তি যার কাছে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ (সা.) মানে কলেমা নাই সেই প্রকৃত ফকির। যার কাছে বেহেশতে যাওয়ার সামানা নাই, সেই হলো প্রকৃত ফকির। যার মধ্যে কলেমা আছে সেই ধনী ও ভাগ্যবান। তিনি বলেন, দুনিয়ার প্রতিটি মানুষের কাছে কলেমার দাওয়াত পৌঁছানো আমাদের দায়িত্ব। কালেমা ছাড়া কেউ বেহেশতে যেতে পারবে না।
বিশ্ব ইজতেমায় আরও ২ মুসল্লির মৃত্যু: গত শুক্রবার রাত ও গতকাল শনিবার বিকাল নাগাদ ময়দানে আরও ৫ মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। এনিয়ে ইজতেমা ময়দানে মোট ৭ মুসল্লির মৃত্যু হলো।

যৌতুকবিহীন বিয়ে: ইজতেমা ময়দানের মিডিয়া সেলের সমন্বয়কারী হাবিবুল্লাহ রায়হান বলেন, শনিবার বাদ আসর বিশ্ব ইজতেমা ময়দানের মূলমঞ্চে ৭২ জোড়া যৌতুকবিহীন বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিয়ে পরিচালনা করেন মাওলানা জোহায়েরুল হাসান। তাবলীগের রেওয়াজ অনুযায়ী ইজতেমার দ্বিতীয় দিন বাদ আসর বয়ান মঞ্চের পাশে বসে যৌতুকবিহীন বিয়ের আসর। কনের সম্মতিতে বর ও কনে পক্ষের লোকজনের উপস্থিতিতে ওই বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। বিয়েতে মোহরানা ধার্য করা হয় ‘মোহর ফাতেমী’র নিয়মানুযায়ী। এ নিয়ম অনুযায়ী মোহরানার পরিমাণ ধরা হয় দেড়শ’ তোলা রুপা বা উহার সমমূল্য অর্থ। বিয়ের পর নব-দম্পতিদের সুখ-সমৃদ্ধিময় জীবন কামনা করে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে মোনাজাতের মাধ্যমে দোয়া করা হয়। এসময় মঞ্চের আশপাশের মুসল্লিদের মাঝে খুরমা খেজুর ও মিষ্টি বিতরণ করা হয়।

আখেরি মোনাজাত উপলক্ষে বাড়তি নিরাপত্তা: আখেরি মোনাজাত উপলক্ষে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে। শনিবার দুপুরে গাজীপুর মেট্রোপলিটনে পুলিশ কমিশনার মাহবুব আলম জানান, আখেরি মোনাজাত উপলক্ষে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। মোনাজাতের দিন অন্যান্য দিনের চেয়ে দ্বিগুণ ফোর্স মোতায়েন করা হবে। তিনি বলেন, গত শুক্রবার লাখ লাখ মুসল্লির সমাগম ঘটেছিল। টঙ্গী থানা এলাকা থেকে স্টেশন রোড পর্যন্ত এবং কামারপাড়া থেকে মন্নুগেট পর্যন্ত সব রাস্তা ব্লক হয়ে গিয়েছিল। মুসল্লিরা রাস্তায় নামাজ আদায় করেছেন। আমরা আশা করছি, আখেরি মোনাজাতের দিনও প্রচুর লোকের সমাগম ঘটবে। সেই কারণে ট্রাফিক ব্যবস্থাও জোরদার করা হয়েছে। তিনি জানান, শনিবার টঙ্গী ব্রিজ থেকে ভোগড়া বাইপাস, টঙ্গী স্টেশন রোড থেকে মীরেরবাজার পর্যন্ত কোনো যানবাহন চলাচল করতে দেয়া হবে না।

মোনাজাতে অতিরিক্ত মাইকের ব্যবস্থা: বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের আখেরি মোনাজাত প্রচারের জন্য গণযোগাযোগ অধিদপ্তর ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে গণযোগাযোগ অধিদপ্তর ইজতেমা ময়দান থেকে আব্দুল্লাহপুর ও বিমানবন্দর রোড পর্যন্ত এবং গাজীপুর সিটি করপোরেশন ইজতেমা ময়দান থেকে চেরাগআলী, টঙ্গী রেল স্টেশন, স্টেশন রোড ও আশপাশের অলিগলিতে পর্যাপ্ত মাইক সংযোগের ব্যবস্থা করেছে বলে জানিয়েছেন সাবেক মেয়র এড. জাহাঙ্গীর আলম।

বিশেষ ট্রেন: টঙ্গীর রেলওয়ে স্টেশনের কর্মকর্তা মো. রাকিবুর রহমান জানান, বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাত উপলক্ষে বাংলাদেশ রেলওয়ের পক্ষ থেকে আখাউড়া, কুমিল্লা ও ময়মনসিংহ সহ বিভিন্ন রুটে প্রায় ১০০টি ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া ১৪টি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া আখেরি মোনাজাতের আগে ও পরে সোনার বাংলা, সুবর্ণা, পর্যটক ও কক্সবাজার এই ৪টি বিশেষ ট্রেন ছাড়া সকল ট্রেন টঙ্গী স্টেশনে যাত্রা বিরতি করবে। এ ছাড়া ইজতেমায় আগত যাত্রীদের কথা বিবেচনায় রেখে টঙ্গী রেলওয়ে জংশনে অতিরিক্ত টয়লেট ও বিশুদ্ধ পানি ও নামাজের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, গত ২০১৬ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ইজতেমা ময়দানে আনুষ্ঠানিকভাবে যৌতুকবিহীন বিয়ে বন্ধ ছিল। তবে বর ও কনে পক্ষের সম্মতিতে তাদের সংশ্লিষ্ট এলাকার মসজিদে যৌতুকবিহীন বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছিল। পুনরায় গত বছর ২০২৩ সাল থেকে ইজতেমা ময়দানে যৌতুকবিহীন বিয়ে চালু করা হয়।

আয়োজক কমিটির বক্তব্য: ইজতেমা আয়োজক কমিটির শীর্ষ মুরুব্বি মহিবুল্লা বলেন, ময়দানে আইনশৃঙ্খলা বজায় থাকায় পরিচ্ছন্নভাবে বিশ্ব ইজতেমা পালিত হচ্ছে। ময়দানে আগত দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মুসল্লি স্বাচ্ছন্দ্যে ইবাদত বন্দেগীতে মশগুল রয়েছে। ইনশাআল্লাহ, আজ আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে ইজতেমা শেষ হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *