সর্বশেষ
Home » অপরাধ » সাভার উপজেলা চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলম রাজীবের হাতে আলাদীনের চেরাগ

সাভার উপজেলা চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলম রাজীবের হাতে আলাদীনের চেরাগ

পাঁচ বছর আগে সম্পদ বলতে ছিল পিতার রেখে যাওয়া ১০ শতাংশ জমি। একটি টিনের ঘর। এখন হাজার কোটি টাকার মালিক। প্রতিষ্ঠা করেছেন রাজকীয় রাজ প্যালেস, রাজ রিয়েল এস্টেট এন্ড কনস্ট্রাকশন, রাজ এগ্রো, রাজ লেদার, রাজ বডি ফিটনেস সেন্টার, আইয়ান ফ্রেশ ডেইরি ফার্ম, রাজ মঞ্জুরী ভিলা, রিভার ভিউ রেস্টুরেন্ট এন্ড পার্টি সেন্টার, ইকোসিটি হাউজিং প্রকল্প, রূপকথা অ্যাপারেলস ও ওয়াসিল উদ্দিন ফাউন্ডেশন নামে প্রায় ডজন খানেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। গড়েছেন বিশেষায়িত শিল্প গ্রুপ ‘রাজ গ্রুপ’। বর্তমানে এই গ্রুপের আনুমানিক সম্পদের পরিমাণ অন্তত ২ হাজার কোটি টাকা। তিনি সাভার উপজেলা চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলম রাজীব। উপজেলা চেয়ারম্যানের চেয়ারই তার হাতে তুলে দিয়েছে আলাদিনের চেরাগ। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুরুল আলম। রাজনীতির শুরুতে হত্যা, চাঁদাবাজি, অপহরণ, মাদক, অস্ত্র ও হত্যাচেষ্টার ডজন খানেক মামলায় জড়িয়েও কীভাবে পার পেয়ে গেলেন? এই প্রশ্ন জনমনে।
সাভার থানার শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকায়ও ছিল রাজীবের নাম। এতকিছুর পরেও কীভাবে উঠে আসলেন, দখল করলেন সাভারের মসনদ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিপুল পরিমাণ টাকা আর নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে ত্রাস সৃষ্টি করেই দ্রুতগতিতে এগিয়ে গেছেন রাজীব। এ পথে কেউ বাধা হলেই তার উপর অস্ত্র নিয়ে হামলে পড়েছেন। চাঁদাবাজি, দখলবাজি, পদ বাণিজ্য, সস্ত্রাসবাদ, টেন্ডারবাজি, গার্মেন্ট দখল, ঝুট ব্যবসার মাধ্যমে ২০১৭ সালের পর থেকে সাভার উপজেলার সর্বত্র একক আধিপত্য বিস্তার করেন রাজীব। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, হকার্স লীগ, শ্রমিক লীগ ও যুব মহিলা লীগ নিজের কব্জায় নিয়েছেন। সবখানেই তার খবরদারী। যার দাপটে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারাও তটস্থ। অল্প সময়েই ভাগ্য বদলে গেছে রাজীবের। সরকারি অফিস, ফুটপাথ, গার্মেন্টস, হাটবাজার, হাসপাতাল, ক্লিনিক, বাসস্ট্যান্ড, সিএনজি স্ট্যান্ড, মসজিদ-মাদ্রাসা, স্কুল-কলেজ সবই রাজীবের অনুসারীদের নিয়ন্ত্রণে। কেউ চাঁদা তোলেন, কেউ আবার বালু, কুলিবিট ও ডিশ ব্যবসা করেন। পরিবহন, নদী ও আবাসন ব্যবসাও তাদের নিয়ন্ত্রণে। ফলে স্রোতের বেগে বেড়েছে সম্পদ। রাজীবের অনুকম্পায় সম্পদে ফুলে ফেঁপে উঠেছে তার সহযোগীরাও। কেউ কেউ দখল করেছেন একাধিক ফ্ল্যাট, প্লট ও জমি। গত কয়েকদিনে সাভারের হেমায়েতপুর সরজমিন ঘুরে মঞ্জুরুল আলম রাজীবের জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের নানা তথ্য পাওয়া গেছে।

শুরুটা ছিল হলমার্ক থেকে:
হলমার্ক দিয়েই প্রথমে রাজীবের সম্পদের যোগান শুরু হয়। অভিযোগ আছে, বন্ধ হয়ে যাওয়া হলমার্কের মেশিনারীজ বিক্রি করে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার মালিক হন মঞ্জুরুল আলম রাজীব ও তার ভাই ফখরুল আলম সমর। অনুসন্ধানে জানা গেছে, হেয়ামেতপুর তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়নের নন্দখোলা এলাকায় হলমার্ক গ্রুপের ৪৩টি কারখানার মেশিন, যন্ত্রাংশ, জেনারেটর, সুতা, কাপড়, হাই ভলিউম লো স্পিড ফ্যান, প্রিন্টিং, ফিনিশিং, ওয়াশিং টেস্টিং, এমব্রয়ডারি, কুলিং যন্ত্র, বয়লার, কারখানার ছাউনি, দরজা, জানালা এমনকি মূল ফটক চুরি হয়। বিদেশ থেকে আনা এক হাজার ২০০ টন সুতা ও ফেব্রিক্সও চুরি হয়। নির্মাণকাজের ৩ কোটি ইট, ১৫০ টন রড ও ১৩০০ বস্তা সিমেন্ট কিনেছিল হলমার্ক। ২০১৪ সালে তাও নাই হয়ে যায়। হলমার্কের নিবন্ধনবিহীন ১০টির বেশি দামি গাড়ি ও কাভার্ড ভ্যানও হারিয়ে যায়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, হলমার্ক গ্রুপের এমডি জেসমিন গ্রেপ্তারের পর তার ভাই শামীম আল মামুন এই কারখানাগুলোর নিয়ন্ত্রণে ছিলেন। পরে শামীমকে হটিয়ে কারখানার নিয়ন্ত্রণ নেন সাভার উপজেলার চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলম রাজীব, ফখরুল আলম সমর ও তাদের অনুসারীরা। প্রায় প্রতি রাতেই ট্রাক ভরে এসব মালামাল সরিয়ে নেন রাজীব। এ কাজে ব্যবহার করা হয় তেঁতুলঝোড়া ৪নং ওয়ার্ডের মেম্বার আইয়ূব আলী, ছোট ভাই কাইয়ূম, ২নং ওয়ার্ডের মেম্বার নাজমুল হোসেন, যুবলীগ নেতা বেলাল আহমেদ, মামুন হোসেন, রিপন, সিরাজ দেওয়ান, অন্তর রহমান, ফয়সাল আহমেদ, নগরচরের সাইফুল আলম, আলী, রবিন, রাজীবের বোন জামাই পরিচয় দেয়া রিপনকে। মালামাল লুটের পর বর্তমানে কারখানাগুলোর ভবন ভেঙে জমি দখল করে প্লট আকারে বিক্রির চেষ্টা করছেন। কিছু জমি জনতা হাউজিং নামে একটি প্রতিষ্ঠান দখলে নিয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হলমার্কের পুরোনো এক নিরাপত্তাকর্মী বলেন, এখানে অনেক বড় একটি স্পিনিং মিল ছিল। ২০১১ সালে হলমার্ক স্পিনিং, আনোয়ার স্পিনিং মিলের জন্য জার্মানি ও জাপান থেকে অত্যাধুনিক ১৩০০ সুইং এন্ড নিটিং মেশিন আমদানি করা হয়। কিন্তু এমডি স্যার গ্রেপ্তার হওয়ার পর ৫ ধাপে রাতের আঁধারে এসব সরিয়ে নেয়া হয়। সরিয়ে নেয়া এলাকার অনেকেই দেখেছে। স্থানীয়রা জানান, ২০১৮ সালে কারখানার মেশিনপত্র, জেনারেটর, টিনের শেডও খুলে নিয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, হলমার্কের বেশির ভাগ কারখানায় যন্ত্রপাতি নেই। খামারের দুই হাজার ৯০০ গরুর মাত্র ৯টি গরু আছে। বিক্রি হয়ে গেছে গোয়ালের অর্ধেক শেডও। আর হলমার্কের মেশিন, জেনারেটর ও যন্ত্রাংশ লুটে নিয়ে সাভার ও গাজিপুরের কয়েকটি কারখানায় বিক্রি করা হয়।

দখলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সম্পদ: হলমার্ক ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের দক্ষিণে সীমানা প্রচীর ঘেঁষা হলমার্কের প্রায় ৫০ শতাংশ জমি দখলে নিয়ে শেড নির্মাণ করে আইয়ান ফ্রেশ ডেইরি নামে একটি গরুর ফার্ম করেছে রাজীব। ফার্মে গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়াসহ প্রায় ৪০০ গবাদিপশু আছে। অভিযোগ রয়েছে, খামারের জমিটি ২০২০ সালে দখল করেন রাজীব। হেমায়েতপুর শহীদ রফিক সেতুর পাড়ে হলমার্কের একটি নির্মাণাধীন কারখানা দখল করে রিভার ভিউ রেস্টুরেন্ট এন্ড পার্টি সেন্টার করা হয়েছে। পাশের ধলেশ্বরী নদীর পাড় দখল করে রেস্টুরেন্টের টং তৈরি করা হয়। দখলের পর রাজীব এই স্থাপনা কাজল, শাওন, রফিকের কাছে ৩০ লাখ টাকা অগ্রিম নিয়ে মাসে ৪০ হাজার টাকায় ভাড়া দিয়ে রেখেছেন। এ ছাড়া সাভার থানা স্ট্যান্ডে ল্যাব জোন হাসপাতালের পেছনে বারী রিহাব সেন্টারের ৫ তলা ভবন দখল করে আবাসিক ভাড়া দিয়ে রেখেছেন রাজীবের শ্যালক সাভার সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম রুবেল। এটা নিয়ন্ত্রণ করে সাভার সদর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি সোহেল রানা। এ ছাড়া হেমায়েতপুর নগরচর পুষ্প ব্রিকসের পাশে নগরচর মৌজা আরএস. ১৬৫নং দাগে ১৫৭ শতাংশ জমি দখল করে একেএইচ ডায়িং এন্ড নিটিং ফ্যাক্টরির কাছে ১৭ কোটি টাকায় বিক্রি করে দেন রাজীব ও তার ভাই ফখরুল আলম সমর। জমির মালিক নিলুফার হক জমি উদ্ধারে আদালতে মামলা করেন। অভিযোগ আছে, ৫ শতাংশ খাস জমি দখলের সময় ব্যক্তি মালিকানাধীন ১৫২ শতাংশ জমি বাউন্ডারি দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়। সাভার আড়াপাড়া মৌজায় এসএ. ২নং দাগে রাজা হরিশচন্দ্রের বাড়ির পুকুর পাড় ঘেঁষা ৪০ শতাংশ অর্পিত সম্পত্তি দখল করে আলিশান ডুপ্লেক্স বাড়ি নির্মাণ করছেন মঞ্জুরুল আলম রাজীব। ৫তলা ভবনের নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। তবে জমিটি নিয়ে আদালতে মামলা চলমান। মামলা নং-২৩৫২/২০১২। আমিনবাজার ইউনিয়নের বরদেশী গ্রামের শেষ মাথা থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার নদী ও ফসলি জমি দখল করে রাজউকের অনুমোদনহীন ইকোসিটি হাউজিং প্রকল্প নামে আবাসন প্রকল্পের সাইনবোর্ড লাগিয়ে শত শত বিঘা জমি দখলে নেয়া হয়েছে। রাজউক প্রজ্ঞাপন দিয়ে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করতে বললেও তা মানেনি। মঞ্জুরুল আলম রাজীব এই দখল কাজে আমিনবাজার ইউপি চেয়ারম্যান রকিব আহমেদকে ব্যবহার করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

খালের মাটি গেছে ইটভাটায়, রাজীবের পকেটে ১৫০ কোটি: ২০২১ সালে ভাকুর্তা ইউনিয়নে বলিয়ারপুর থেকে মুশুরীখোল ব্রিজ পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার তেঁতুলঝোড়া ভাকুর্তা ও যাদুরচর খাল খনন করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ছিল সালেহ এন্ড ব্রাদার্স। প্রায় ৩৫০ ফিট চওড়া ও ২০ ফিট গভীর খালের পাড়ে কোনো মাটি নেই। স্থানীয়রা বলছে, ভেকু দিয়ে খননের পরে রাতের আঁধারে ডাম্প ট্রাকে করে লাখ লাখ ঘনফুট মাটি অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়। সূত্র বলছে, খালের মাটি তুরাগ ব্রিকস, সনি ব্রিকসসহ আশপাশের ইটভাটা ও হাউজিং প্রকল্পের কাছে বিক্রি করা হয়। এতে দেড় বছরে প্রায় ১৫০ কোটি টাকার মাটি বিক্রি করা হয়। সাভার উপজেলা চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলম রাজীবের সহায়তায় এই কাজ নিয়ন্ত্রণ করেন ভাকুর্তা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান লিয়াকত হোসেন ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী আব্দুল বাতেন। মাটি বিক্রির টাকা দুই হাত ঘুরে রাজীবের কাছে চলে যায়।

রাজীব-সমর সহোদরের গাড়িবিলাস: ২০১৯ সালে নির্বাচনী হলফনামায় উল্লেখ করা হয় রাজীবের ব্যক্তিগত গাড়ি নেই। কিন্তু নির্বাচনের পরে ৫ বছরে নানা ব্র্যান্ডের ৮টি নামিদামি গাড়ি কিনেছেন। গাড়ির মধ্যে রয়েছে- মার্সিডিজ বেঞ্জ ঢাকা মেট্রো ঘ ১৮-৯১৯৬, ল্যান্ড ক্রুজার প্রাডো ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩-৬৩৩১, ল্যান্ড ক্রুজার প্রাডো ঢাকা মেট্রো ঘ-১১-৭৯১১, ল্যান্ড ক্রজার প্রাডো ঢাকা মেট্রো ঘ-১৮-২৮৯৬, টয়োটা প্রিমিও ঢাকা মেট্রো ঘ-২৯-৩৬২৫, নোহা এক্স ঢাকা মেট্রো চ-১১-৬৯৬৫, এ ছাড়াও ছাদখোলা দুটি জিপ ও রাজীবের স্ত্রীর হ্যারিয়ার ১৮ মডেলের একটি প্রাইভেটকার রয়েছে।

রাজীবের ত্রাসের রাজত্বে হাতিয়ার যারা: উপজেলাব্যাপী রাজীবের খবরদারি, লুটপাট, হামলা, দখলবাজি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও রাজনৈতিক প্রটোকল দেন স্থানীয় কিছু চিহ্নিত ব্যক্তি। তাদের দিয়ে দল ও দলের বাইরে অনেক নেতাকে মারধর ও হুমকি দেয়া হয়। বাহিনীর সদস্যদের সবাই চাঁদাবাজি, অস্ত্র, ধর্ষণ, দখলবাজি, হত্যাচেষ্টা, অপহরণ ও মারধর মামলার আসামি। সাভারের অলিগলিতে এই বাহিনীর সদস্যরা ত্রাস সৃষ্টি করে রাখেন। স্কুল কলেজে ভর্তি বাণিজ্য, বাজার মসজিদ কমিটি নিয়ন্ত্রণ করেন এই বাহিনী। এই বাহিনীর সদস্যেদের মধ্যে রয়েছে উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আতিকুর রহমান আতিক, পৌর ছাত্রলীগের সভাপতি মাসুম ওরফে মুরগি মাসুম, ছাত্রলীগ নেতা পাভেল ওরফে তোতলা পাভেল, সদর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি সোহেল, যুবলীগ নেতা বাবু ওরফে টয়লেট বাবু, সদর ইউপি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম রুবেল, গালকাটা বাবু, টোকাই নাজমুল, তেঁতুলঝোড়া ইউপি ছাত্রলীগ সভাপতি লুৎফর রহমান পাভেল, সাভার কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফ আহমেদ নাসিম, সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম হোসেন, উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সেক্রেটারি রব খান সজীব, ছাত্রলীগ নেতা আবির মাসুম।

দুই ভাইয়ের যত মামলা: ১৯৮৭ সালে চঞ্চল হত্যা, ১৯৯৬ সালে মজনু হত্যা, ১৯৯৮ সালে ব্যাংক কলোনি এলাকায় খন্দকার জেনারেল স্টরের সামনে তেল ব্যবসায়ী সাইদুর রহমানকে গুলি করে হত্যা, ২০০২ সালে ঘোষপাড়ার হানিফ হত্যা, আড়াপাড়ার ছাত্রদলকর্মী বাবু হত্যা, ২০১০ সালে হেমায়েতপুরে বাড়ি নির্মাণে চাঁদা না দেয়ায় গুলি করে এখলাস হত্যার মধ্যদিয়ে আলোচনায় আসেন মঞ্জুরুল আলম রাজীব ও ফখরুল আলম সমর। এ ছাড়া ১৯৯৫ সালে আড়াপাড়া এলাকায় টং দোকানে অস্ত্র রাখার দায়ে রাজীবকে গাড়ির পেছনে বেঁধে টেনেহিঁচড়ে থানায় নেয় পুলিশ। ১৯৮৭ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত রাজীব সমরের বিরুদ্ধে হত্যা, হত্যাচেষ্টা, চাঁদাবাজি, দখল, অস্ত্র, মাদক, মারধর, পুলিশের উপর হামলার অভিযোগে অন্তত ১৭টি মামলা হয়। এমনকি ২০১০ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত সাভার থানার শীর্ষ সন্ত্রাসী তালিকায় প্রথম স্থানে রাজীবের নাম ছিল। অনুসন্ধানে হত্যা ও চাঁদাবাজির ৮টি মামলার নথি পাওয়া গেছে। সাভার থানার মামলা নং-৩৫(১০)০১, সাভার থানা ৪৩(০৮)০২, সাভার থানা ১৩(১১)৯৬, সাভার থানা ৪৮(০৬)৯৪, সাভার থানা ১১(০৭)৯৫, সাভার থানা ৭৪(০৬)১০, সাভার থানা ৩৪(০৬)১১, সাভার থানা ১৭(০৪)১১। তবে অধিংকাশ মামলাই বাদীকে চাপ দিয়ে তুলে নিতে বাধ্য করা হয়। সাবেক এক আইন প্রতিমন্ত্রীর সহায়তায় হত্যা মামলাগুলো রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড দেখিয়ে খালাস পান তারা। তবে মামলার বাদীরা এখনো বিচারের অপেক্ষায় আছেন।

৫ পার্সেন্ট জাকির মামা: রাজীবের প্রধান নিয়ন্ত্রক জাকির হোসেন নামে এক যুবলীগ নেতা। সরকারি অফিসের সব চাঁদাবাজির টাকা জাকিরের মাধ্যমেই রাজীবের হাতে যায়। চাঁদার প্রধান স্পট রেজিস্ট্রার অফিস। খাজনা খারিজ, হেবা দলিল, তারিখ ভুল, নাম ভুল, ব্যাকডেটে দলিল, বয়স পাল্টে দেয়া, বিএসে ভুলেও দলিল হওয়া, মৃত ব্যক্তিকে জীবিত দেখিয়ে দলিল হয় সাভার সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে। এখানে দৈনিক প্রায় ১৫ লাখ টাকার লেনদেন হয়। চাঁদার টাকা তোলেন আব্দুল আলিম ও আমিনুল মুমিনিন জাপান। প্রতিদিন রাজীবের সহকারী জাকির হোসেনের কাছে প্রায় ১০ লাখ টাকা যায়। পরে সেই টাকা রাজীবের হাতে পৌঁছায়। এলজিইডি, জনস্বাস্থ্য, সড়ক জনপদ, শিক্ষা প্রকৌশল, পানি উন্নয়ন বোর্ড, গণপূর্ত, বিআরটিএ, বিদ্যুৎ অফিস, যুব উন্নয়ন অফিস, ভূমি অফিস, সমাজসেবা অধিদপ্তর, পরিবার পরিকল্পনা, কৃষি, মৎস্য, প্রাণী ও খাদ্য বিষয়ক উপজেলা অফিস, প্রাণিসম্পদ অফিস, ভূমি ও রাজস্ব বিষয়ক অফিসের সব ধরনের কাজে জাকিরকে ৫ শতাংশ চাঁদা দিতে হয়। চাঁদাবাজির কাজে জাকির ছাত্রলীগ নেতা আতিক, মাসুম, পাভেল, রুবেল, সোহেলকে ব্যবহার করেন।

ঝুট ব্যবসায় ফকির থেকে কোটিপতি: হেমায়েতপুর ও আশপাশের এলাকায় প্রায় ৯১০টি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি আছে। এই কারখানার ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান রাজীবের ছোট ভাই ফখরুল আলম সমর। প্রতি মাসে ২ ধাপে গার্মেন্টসগুলো থেকে ঝুট বের করা হয়। ঝুট রাখা হয় পদ্মার মোড় রাজ প্যালেসের বেজম্যান্টে ও হলমার্কের ভেতর কবিরের গোডাউনে। এই ৯ শতাধিক কারখানা থেকে মাসে প্রায় ৯৬ কোটি টাকার ঝুট নামানো হয়। এমন তথ্য দিয়েছেন কাটা কাপড় ব্যবসায়ী সমিতির এক নেতা। ঝুটের বিনিময়ে নির্বিঘ্নে ব্যবসা করতে সহায়তা করা হয়। তবে অনেক গার্মেন্টস থেকে মাসিক নগদ চাঁদা নেয়ারও অভিযোগ আছে। হেমায়েতপুরের ভার্টেক্স, একেএইচ, শাহনাজ অ্যাপারেলস, ব্যাবিলন ওয়াশিং, জাকির গার্মেন্টস, ল্যাভেল ট্যাক্স, এবি অ্যাপারেলস, আবনি গার্মেন্টস, আমান নিটিং, আলেয়া অ্যাপারেলস, বিএনএম’সহ প্রায় ২ শতাধিক গার্মেন্টসে চাঁদা আদায় করেন তেঁতুলঝোড়া ২নং ওয়ার্ডের মেম্বার নাজমুল হোসেন, বেলাল, মামুন। ২০০৯ সালের ২রা জানুয়ারি ফুলবাড়িয়া ডার্ড গার্মেন্টসের পাশে ফাহিম ইক্সিম বাংলা লিমিটেড ফ্যাক্টরি জিএমকে মারধর করে অস্ত্রের মুখে সমর,আইয়ুব, নাসির ১০ লাখ টাকা চাঁদা নেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভুক্তভোগী নিজেই এই তথ্য দেন।

ফুটপাথ, পরিবহন থেকে ৫০ কোটি: সাভারে পরিবহন ও ফুটপাথ কেন্দ্রিক বছরে প্রায় ৫০ কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয়। গত ৫ বছর ধরে এই স্পটগুলো একক নিয়ন্ত্রণ করেছেন আতিক গং। একেক স্থানে একেক জনকে দায়িত্ব দিয়ে ফুটপাথ থেকে চাঁদা তোলা হয়। সাভার পুরোনো ওভারব্রিজ থেকে সিটি সেন্টার পর্যন্ত রাস্তার পশ্চিম পাশে ৪০০ দোকান থেকে দোকানপ্রতি দৈনিক ৪০০ টাকা চাঁদা তোলেন হকার্স লীগ নেতা কবির উদ্দিন। অন্ধ মার্কেট নিয়ন্ত্রণ করেন তোতলা পাভেল। ওই মার্কেটের সামনের ফুটপাথে ২০০ দোকান ও প্রায় ৪০০ অটোরিকশা থেকে দৈনিক প্রায় ১ লাখ টাকা চাঁদা তোলেন পাভেল। কিছুদিন আগে মার্কেটের ১০টি দোকান দখলে নিতে ব্যবসায়ীদের মারধর করেন পাভেল। সাভার নিউমার্কেট থেকে গেন্ডা পর্যন্ত রাস্তার পূর্ব পাশের ফুটপাথ, সিএনজি, লেগুনা, অটোরিকশা, কাঁচাবাজার, মাছ বাজার, রেন্ট এ-কার, সবজি বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন পৌর ছাত্রলীগের সভাপতি মাসুম দেওয়ান ওরফে মুরগি মাসুম। প্রায় দেড় হাজার দোকান থেকে দৈনিক দোকানপ্রতি ৪০০ টাকা চাঁদা তোলা হয়। ৫০০ সিএনজি, অটো, লেগুনা, প্রাইভেটকার থেকে প্রতিদিন ৮০ টাকা চাঁদা নেয়া হয়। সম্প্রতি ইউনুস নামের এক ব্যবসায়ীর কাছে ১০ লাখ চাঁদা চেয়ে চাঁদাবাজির মামলা খান মাসুম। সাভার থানা মামলা নং ২৮(০৭)২৩। এ ছাড়া রেডিও কলোনির দুইপাশে ফুটপাথের দোকান ও বাসস্ট্যান্ড নিয়ন্ত্রণ করেন বাবু ওরফে টয়লেট বাবু। সাভার সদর ইউনিয়নের ফুটপাথ ও অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণ করেন সোহেল ওরফে ধর্ষণ সোহেল। এই এলাকা থেকে দৈনিক প্রায় ৫০ হাজার টাকা চাঁদা তোলা হয়। উলাইল পাইকারি বাজার, ব্যাংক টাউন পর্যন্ত ফুটপাথ, সবজি বাজার, বাস স্টপেজ, প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক থেকে দৈনিক প্রায় ৪ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয়। এটা নিয়ন্ত্রণ করে রাজীবের শ্যালক মাজহারুল ইসলাম রুবেল। সাভার সদরের ইন্টারনেট ও ডিশ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন উপজেলা ছাত্রলীগ সভাপতি আতিকুর রহমান আতিক। ২৫০০ সংযোগ থেকে মাসে প্রায় ১৩ লাখ টাকা তোলা হয়। এই টাকা থেকে আতিককে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দিতে হয়। তবে সম্প্রতি সাইফুল ইসলাম এমপি হওয়ার পরে ফুটপাথ তুলে দেন। কৌশলে পুনরায় ফুটপাথ বসাতে রাজীব হকারদের দিয়ে উপজেলা ঘেরাও করিয়েও ফল পায়নি।

নামে-বেনামে কেনা যত জমি: সিংগাইর উপজেলার বাস্তার জামির্তা ইউনিয়নের সুদক্ষীরা মৌজায় আর.এস ৬০ নং দাগ বর্তমানে বিএস ৯৬ দাগে ২৬০ শতাংশ জমি কিনেছেন রাজীব। জমিটি তার পিএস সোহানুর রহমানের নামে কিনেছেন। ওই জমির মূল মালিক রহমতউল্যাহ। জমিটি নিয়ে আদালতে মামলা চলছে। মাস কয়েক আগেও ওই জমিতে রাজীবের নামে সাইনবোর্ড লাগানো ছিল। তবে মামলার পরে সাইনবোর্ড সরিয়ে নিয়েছে। সিংগাইর জয়মন্টপ ইউনিয়নের বানিয়াড়া মৌজায় ৭৮ শতাংশ জমি কিনেছেন সোহান। এই জমি কিনতে খরচ হয়েছে ৯৮ লাখ টাকা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজীব তার অনুসারীদের নামে জমি কিনে নিজের নামে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিয়ে রাখেন। যাতে সময় সুযোগ বুঝে তিনি সম্পত্তি ফিরিয়ে নিতে পারেন। এমন কয়েকটি কাগজ এসেছে এই প্রতিবেদকের হাতে।

তেঁতুলঝোড়ায় ১৩ খুন: মঞ্জুরুল আলম রাজীব ও ফখরুল আলম সমরের বাড়ি তেঁতুলঝোড়ায়। সমর এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। ইউনিয়নের কোনো গাছের পাতা পড়লেও সমরের অনুমতি লাগে। ইউনিয়নজুড়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছেন তিনি। জমি বিক্রি, বাড়ি নির্মাণ, দোকান খোলা, নতুন ব্যবসা চালু করা, ফ্ল্যাট বিক্রি, হাটবাজার, মসজিদ, স্কুল কলেজ কমিটি, এমনকি বিয়ে সাদি করলেও সমর চেয়ারম্যানকে জানিয়ে করতে হয়। ইউনিয়নব্যাপী সমরের একটি প্রক্সি বাহিনী আছে। নানা জায়গায় সুবিধা আদায় করতে এই বাহিনীর সদস্যরা মারধর, হত্যা, খুন-খারাবিতে ব্যস্ত থাকেন। ফলে গত ১০ বছরে শুধুমাত্র তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়নেই ১৩ জন খুন হয়েছে। খুনির পরিচয় জেনেও অনেকে মামলা করতে পারেনি। গত ১লা অক্টোবর রাতে হলমার্কের মালামাল চুরিতে বাধা দেয়ায় খুন হন ওই প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তাকর্মী রয়েল সরকার। ২০২৩ সালে ১৮ই ফেব্রুয়ারি রাতে হেমায়েতপুর বাসস্ট্যান্ডে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয় গাড়ি ব্যবসায়ী শাহাব উদ্দিন ও মুসাকে। ২০২২ সালে ২রা জানুয়ারি রাতে তেঁতুলঝোড়ার রাজফুলবাড়িয়ায় এনামুল নামে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ২০১৯ সালের ১১ই এপ্রিল সাভারে তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতি হুমায়ুন কবিরকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তিনি ওই বছর ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলেন।

কীভাবে গার্মেন্টসকর্মী থেকে মালিক রাজীবের শ্যালক: মঞ্জুরুল আলম রাজীবের স্ত্রী শ্রাবণী আক্তারের বড় ভাই মাজহারুল ইসলাম রুবেল একসময় গার্মেন্টস শ্রমিক ও শ্বশুর স্থানীয় ধলেশ্বরী গার্মেন্টসের দারোয়ান ছিলেন। তবে রাজীব চেয়ারম্যান হওয়ার পরে সম্পদে ফুলে ফেঁপে ওঠে রুবেল। দখলবাজি, টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজি করে অল্পদিনেই শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক হন। ব্যাংক টাউনে জমি দখল করে ৮ তলা আলিশান বাড়ি করেন। মালিক হয়েছেন গার্মেন্টসেরও। বটতলার গরুর ফার্ম, গেন্ডা ও বিলবাগিল মৌজায় ৭০ বিঘা জমি কিনেছেন। ব্যাংক টাউনে ফ্ল্যাট কিনেছেন ১২টি। পেয়েছেন আওয়ামী লীগের বড় পদও।

যা বলেছেন রাজীব: অভিযোগের বিষয়ে মঞ্জুরুল আলম রাজীব বলেন, আমি কোনো অনিয়মের সঙ্গে জড়িত নই। কেউ যদি আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ দিয়ে থাকেন এবং আপনারা যদি কোনো অভিযোগ পান, সেটা ভিত্তিহীন। কেউ হয়তো ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এই অভিযোগ দিয়েছেন। হলমার্কের জমি আমি দখল করিনি। আমার গরুর ফার্ম হলমার্কের বাউন্ডারির বাহিরে। আর হলমার্কের কোনো মালামাল আমরা নেইনি। কে বা কারা নিয়েছে তা আমি অবগত নই। দ্রুতই হলমার্ক এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়ে দিবে। বরদেশী মৌজায় ইকোসিটি হাউজিং প্রকল্প দিয়ে নদী ও ফসলি জমি দখলের বিষয়ে তিনি বলেন, ইকোসিটি নামে আমার কোনো হাউজিং প্রকল্প নেই। এই নাম প্রথম শুনলাম। আর আমি কখনো কারও জমি দখল করিনি। আমার ভাইও এসব করে না। দলের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির বিষয়ে রাজীব বলেন, আমি সাভার আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করতে কাজ করছি। এখানে কোনো বিভেদ নেই। আর সহযোগী সংগঠনের কমিটি আমি দেয়ার কে? কমিটি তাদের কেন্দ্রীয় নেতারাই দিয়েছে। আমার কোনো সম্পদ বাড়েনি। যা দেখেন, এগুলো আমার ব্যবসা থেকে আয় করা। বৈধ আয়ের সম্পদ। লুটপাটের রাজনীতি আমি করি না। এসব প্রশ্রয়ও দিই না।
সুত্রঃ মানবজমিনকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *