সর্বশেষ
Home » অন্যান্য » অন্যান্য বিশেষ সংবাদ » অতি ঝুঁকিতে দেশের ৯টি বাণিজ্যিক ব্যাংক আতঙ্কে গ্রাহক

অতি ঝুঁকিতে দেশের ৯টি বাণিজ্যিক ব্যাংক আতঙ্কে গ্রাহক

পরিস্থিতি বিবেচনায় দেশের ৯টি বাণিজ্যিক ব্যাংক অতি ঝুঁকিতে রয়েছে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকগুলোর পারফরমেন্সের ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ‘ব্যাংকস হেলথ ইনডেক্স (বিএইচআই) অ্যান্ড হিট ম্যাপ’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে এই ৯টি ব্যাংককে রেড জোনে রাখা হয়। এ ছাড়া ইয়েলো জোনে রাখা হয়েছে ২৯টি ব্যাংক এবং গ্রিন জোনে আছে ১৬টি ব্যাংক। রেড জোনে থাকা ৯টি ব্যাংকের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক রয়েছে ৪টি। অর্ধবার্ষিক পারফরমেন্সের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি বিভাগ। রেড জোনে থাকা ব্যাংকগুলো মূলত আর্থিকভাবে ভঙ্গুর অবস্থা পার করছে। ইয়েলো জোনে থাকা ব্যাংকগুলো মধ্যবর্তী অবস্থায় রয়েছে। আর গ্রিন জোনে থাকা ব্যাংকগুলো সূচকের দিক থেকে কিছুটা ভালো অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এমন এক সময় প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে যখন দুর্বল ব্যাংকগুলোকে ভালো অবস্থায় থাকা ব্যাংকগুলোর সঙ্গে একীভূতকরণ ও অধিগ্রহণ নিয়ে আলোচনা চলছে। এদিকে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের রেড জোন থেকে বের হতে এসব ব্যাংক আমানত সংগ্রহে বেপরোয়া সুদ অফার করছে গ্রাহকদের।

সেক্ষেত্রে ১৩-১৪ শতাংশ পর্যন্ত সুদ অফার করছে কোনো কোনো ব্যাংক। এ হিসাবে আমানত সংগ্রহ করলে এসব ব্যাংককে ঋণ দিতে হবে ১৬-১৭ শতাংশ সুদে। এ প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়ে কিছু নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানও আমানত পেতে ১৭-১৮ শতাংশ সুদ অফার করছে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, ঋণ আদায়ে মন্দা ও ভাবমূর্তি সংকটের কারণে কিছু ব্যাংক আগে থেকেই তারল্য সংকটে ছিল। তারা বাড়তি সুদ দিয়ে আমানত সংগ্রহ করছিল। কোনো কোনো ব্যাংকে সাড়ে পাঁচ বছরে টাকা দ্বিগুণের প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছে। সেক্ষেত্রে সঞ্চয়পত্র ও বন্ডের চেয়েও বেশি সুদের অফার করছে এসব ব্যাংক।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে এমন কোনো ব্যবসা নেই, যা দিয়ে আমানতের এ টাকা পরিশোধ করা যাবে। আমানত সংগ্রহে এমন বেপরোয়া নীতির কারণে ঋণের সুদও বেড়ে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে বিপাকে পড়ছেন ঋণগ্রহীতারা। বিশেষ করে ভুগতে হবে ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তাসহ ব্যাংকের ঋণগ্রহীতাদের। এ ছাড়া এমন অসম সুদে আমানত সংগ্রহের যে নীতিতে নেমেছে দুর্বল ব্যাংকগুলো সেটিও ভালো লক্ষণ নয়। কারণ চটকদার অফারে অনেকে না বুঝে ব্যাংকে আমানত রাখবেন। সেক্ষেত্রে শঙ্কা রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আতঙ্কে আছেন ব্যাংকে আমানত রাখা গ্রাহকরাও। অনেকে মূলধন হারানোর শঙ্কা করছেন। কারণ যে বেপরোয়া নীতিতে আমানত সংগ্রহ করা হচ্ছে ব্যাংকগুলোর সেই টাকা ঋণ দিয়ে অতিরিক্ত সুদ অর্জন করা অনেকটা কঠিন। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, দুর্বল ব্যাংকগুলো ভালো ব্যাংকগুলোর সঙ্গে একীভূত হলেও তার আমানতকারীদের স্বার্থের কোনো হানি হবে না। গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলো চাইলে স্বেচ্ছায় একীভূত হতে পারবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ এ বিষয়ে বলেন, উচ্চ সুদের অফার পেলেই যেকোনো ব্যাংকে আমানত রাখা যাবে না। সেক্ষেত্রে দেখতে হবে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি কেমন।

জানা গেছে, অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার ভয়ে কয়েকটি দুর্বল ব্যাংক আমানত সংগ্রহে এ বেপরোয়া নীতি গ্রহণ করছে। সেক্ষেত্রে প্রকাশ্যে সুদের অফার ছাড়াও কেউ কেউ ক্ষুদে বার্তায়ও আমানত সংগ্রহে অফার দিচ্ছে। গোপনীয়তার আশ্রয় নিচ্ছে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান। টাকার অঙ্ক ও মেয়াদ বাড়লে বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে সুদের হার। সেক্ষেত্রে ১৪-১৮ শতাংশ পর্যন্ত সুদ অফার করা হচ্ছে। এদিকে ব্যাংক ঋণের আনুষ্ঠানিক সুদের হারও বেড়েছে। গত জুলাইয়ে বেঁধে দেয়া ৯ শতাংশ সুদের হার তুলে নেয়ার পর যেটি ইতিমধ্যে ১৩ শতাংশ ছাড়িয়েছে। মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন পদ্ধতি অনুসরণ করতে গেলেই ঋণের সুদ বাড়ছে। ঋণের সুদ বেশি বেড়ে যাওয়ায় সুদহার নির্ধারণ পদ্ধতিতে কিছুটা পরিবর্তন এনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমানে ‘সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল’ বা স্মার্ট পদ্ধতিতে ঋণের সুদের ভিত্তি হার নির্ধারিত হয়। তার সঙ্গে যুক্ত হয় বাড়তি ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদ। এ দুইয়ে মিলে ঋণের চূড়ান্ত সুদহার নির্ধারণ করে ব্যাংকগুলো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের রেড জোনে থাকা ব্যাংকগুলো হলো- বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, ন্যাশনাল ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক ও এবি ব্যাংক। ইয়েলো জোনে থাকা ব্যাংকগুলো হলো- রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকসহ ১৯টি বেসরকারি ব্যাংক এবং ৮টি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক।

গতকাল সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, আগামী বছরের মার্চে নীতিমালা অনুযায়ী যারা দুর্বল তালিকায় পড়বে, তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়া হবে। আন্তর্জাতিক চর্চা অনুসরণ করে কোন পদ্ধতিতে ও কী প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ব্যাংক একীভূত হবে, তা নিয়ে প্রণয়ন করা হবে নীতিমালা। ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ব্যাংক একীভূত হওয়া নিয়ে নানা ধরনের অনুমানভিত্তিক কথা হচ্ছে। যে প্রক্রিয়ায় ব্যাংক একীভূত হোক না কেন, এতে আমানতকারীদের স্বার্থের কোনো হানি হবে না। একইসঙ্গে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থও দেখা হবে।

তিনি বলেন, যেসব ব্যাংক একীভূত হবে, ওই ব্যাংকগুলোর স্বাস্থ্য ভালো নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান দিয়ে পরীক্ষা করা হবে। এরপরই একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হবে। ব্যাংক একীভূত হলে তা হবে যথাযথ ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়। একীভূত হলে ভালো ব্যাংক যাতে দুর্বল না হয় ও দুর্বল ব্যাংক যাতে ভালো হয়- এ দুটিই দেখা হবে। এদিকে ব্যাংক একীভূত করার খবরে গত ৪ঠা মার্চ ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) একটি প্রতিনিধিদল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে দেখা করে। এ সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়ে দেয়, চলতি বছরের মধ্যে ৭ থেকে ১০টি দুর্বল ব্যাংক সবল বা ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে পারে। এ সময়ের মধ্যে দুর্বল ব্যাংকগুলো নিজেদের ইচ্ছায় একীভূত না হলে আগামী বছর থেকে তাদের চাপ দিয়ে একীভূত করা হবে। ওই বৈঠকে আরও জানানো হয়, দুর্বল ব্যাংকের খারাপ সম্পদ (ঋণ) কিনে নেবে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি (এএমসি)। ফলে একীভূত হওয়ার কারণে ভালো ব্যাংকগুলোর খারাপ হয়ে পড়ার আশঙ্কা নেই। তবে দুর্বল ব্যাংকগুলোর পরিচালকরা ভালো ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার যোগ্যতা হারাবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *