সিরিজ জিতিয়ে কে হবেন নায়ক! তানজিদ তামিম, মেহেদী হাসান মিরাজ, নাকি মুশফিকুর রহীম? সিরিজ নির্ধারণী ম্যাচে ২৩৬ রানের জবাব দিতে নেমে ঘটনা প্রবাহ যেন জমজমাট নাটকের মতো। সেঞ্চুরির কাছে গিয়ে আউট হন তামিম, এরপর একটা সময় মনে হচ্ছিল দলের জয় নিয়ে মাঠ ছাড়বেন মুশফিক-মিরাজ। কিন্তু কে জানতো শেষ বেলায় ম্যাচ সেরার পুরস্কারটা নিজের করে নিবেন রিশাদ হোসেন! বোলার হিসেবে একাদশে সুযোগ পাওয়া এই লেগস্পিনার ৯ ওভারে ৫০ রান খরচ করে নিয়েছেন এক উইকেট। মোটেও আহামরি নয়, কেউ কেউতো বলেই ফেলছেন এইজন্যই লেগ স্পিনাররা দলে জায়গা পাননা। কিন্তু তাতে কী! ব্যাট হাতে ঝড় তুলে ১৮ বলে খেলেন ৪৮ রানের অপরাজিত ইনিংস। তার এমন বিধ্বংসী ব্যাটিংয়ে ম্যাচ জয়ের পাশাপাশি সিরিজ নিশ্চিত হয় বাংলাদেশের।
জয়ের জন্য বাকি ৫৮ রান! ঠিক তখন আউট হয়ে গেলেন মিরাজ। ১৭৮ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে বিপদ বাড়ে টাইগারদের। যদিও তখন ১৬ ওভার বাকি কিন্তু হাতে আছে ৪ উইকেট। যারা আসবেন তারা সবাই বোলার! যে কারণে আশার সঙ্গে হারের শঙ্কাটাও ভীষণ। রজমান মাস, তার উপর তীব্র তাপ সহ্য করে মাঠে আসা দর্শকরা অবশ্য মনের জোর হারাননি।
চট্টগ্রাম জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে তখনো বাংলাদেশ, বাংলাদেশ চিৎকার। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে ব্যাটে ঝড় তুলে জয়টা ছিনিয়ে নেন রিশাদ। শেষ পর্যন্ত ৫৮ বল বাকি থাকতেই ৪ উইকেটের জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে বাংলাদেশ।
এর আগে টাইগারদের দারুণ বোলিংয়ে মাত্র ২৩৬ রানেই গুটিয়ে গিয়েছিল টসে জিতে ব্যাট করতে নামা শ্রীলঙ্কা। অন্যদিকে জবাব দিতে নামার আগেই বিপদে ছিল নাজমুল হোসেন শান্তর দল। ওপেনার সৌম্য সরকারের মাথায় বলের আঘাত লেগেছে। তাই কনকাশন সাব হিসেবে মাঠে নামাতে হয়েছে তরুণ ওপেনার তানজিদ তামিমকে। লিটন দাস ফর্মের কারণে বাদ তাই এনামুল হক বিজয় একাদশে সুযোগ পেয়েছেন। রান তাড়ায় নেমে তাই সাবধানী শুরু। তবে ১২ রানে ফিরেন সাজঘরে। এরপর টাইগার অধিনায়ক মাত্র ১ রানে আউট হয়ে দলকে আরও বিপদে ফেলেন। তবে সুযোগ পেয়েই তামিম হয়ে ওঠেন বেপোরোয়া। ইনিংসে ৮৪ রান করেছেন বাঁহাতি ওপেনার। ৮১ বলে ৯ চারের সঙ্গে মেরেছেন ৪টি ছক্কা। তবে সেঞ্চুরি হাতছাড়া করে আউট হন তিনি। শুরুতে তামিম আর শেষে রিশাদ দু’জনের ভয়ডরহীন ব্যাটিংয়ে লঙ্কানদের বিপক্ষে ২-১-এ সিরিজ নিশ্চিত করে বাংলাদেশ।
সিলেটে টি-টোয়েন্টি সিরিজ হেরেছে দল। মূলত সেই সিরিজে নিজেদের ব্যাটিং- বোলিংয়ের ভুলের মাসুল দিতে হয়েছে হার দিয়ে। তবে ওয়ানডে ফরম্যাটে নিজেদের মাটিতে যে কোনো দলের জন্য কঠিন প্রতিপক্ষ টাইগাররা। যদিও সবশেষ দুই সিরিজ হেরেছে নিজেদের মাঠে। যে কারণে জয়ে ফেরার কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিল নয়া অধিনায়ক শান্তর সামনে। প্রথম ম্যাচে অধিনায়কের সেঞ্চুরিতে দুর্দান্ত জয় তুলে নিয়ে সিরিজ জয়ের সুযোগ তৈরি করে বাংলাদেশ। পরের ম্যাচে ২৮৭ রান করেও হয়ে পড়ে সিরিজ খোয়ানোর শঙ্কাতে। তবে ব্যাটে-বলে নিজেদের সেরাটা দিয়ে লঙ্কার বিপক্ষে দ্বিতীয় সিরিজ জিতে নেয় শান্তর দল। সিরিজ সেরাও হন টাইগার অধিনায়ক। তার ব্যাট থেকে তিন ম্যাচে এসেছে ১৬৬ রান। তবে ১৭৭ রান করে শীর্ষে আছেন জেনিথ লিয়ানাগে।
অন্যদিকে তাইজুলের পরিবর্তে একাদশে সুযোগ পেয়ে রিশাদ তার যোগ্যতার প্রমাণ রাখেন। তার ব্যাটিং ঝড়ে সপ্তম উইকেটে ২১ বলে পঞ্চাশ রানের জুটি পায় বাংলাদেশ। এর মধ্যে ৪০তম ওভারে ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গার বলে রিশাদ নেন ২৪ রান। ২ ছক্কায় ওভার শুরুর পর টানা ৩টি চার মারেন তিনি। শেষ বল ডট খেলেন তিনি। তখন ৪০ ওভারে বাংলাদেশের সংগ্রহ ৬ উইকেটে ২৩৩ রান। জয়ের জন্য প্রয়োজন আর ৩ রান। বাংলাদেশের হয়ে ওয়ানডেতে দ্রুতমম ফিফটির কাছে তখন দাঁড়িয়ে রিশাদ। কিন্তু পরের ওভারে তার আর ব্যাট করার সুযোগ হয়নি। ৪০তম ওভারে থিকশেনার দ্বিতীয় বলে মুশফিক চার হাঁকান। এতেই আশরাফুলের গড়া রেকর্ড হাতছাড়া হয় রিশাদের। ২০০৫-এ নটিংহ্যামে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২১ বলে ৫০ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলেছিলেন আশরাফুল।
রিশাদের এমন ইনিংসে ভাগ্যও দারুণ সঙ্গ দিয়েছে। ক্রিজে গিয়ে প্রথম বলে সুইপ করে ছক্কা মারলেন তিনি। পরের বল প্যাডে লাগতেই এলবিডব্লিউ’র জোরালো আবেদন। তাতে সাড়া দেননি আম্পায়ার। কিছুক্ষণ আলোচনার পর রিভিউ নেয় শ্রীলঙ্কা। রিপ্লেতে দেখা যায়, বলটি হালকা ছুঁয়ে যেতো লেগ স্ট্যাম্প। যার ফলে স্ক্রিনে ভেসে ওঠে ‘আম্পায়ার্স কল।’ অর্থাৎ মাঠের আম্পায়ার ‘নট আউট’ দেওয়ায় সেটিই বহাল থাকে। আম্পায়ার আউট দিলে ফিরতে হতো রিশাদকে। বেঁচে যাওয়ার পরের বলেই বাউন্ডারি মারেন রিশাদ। এরপর ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গাকে আবার সুইপ শটে মারেন ছক্কা। ওভার থেকে আসে ১৬ রান। আগে ছক্কা মারার চেষ্টায় আউট হন মিরাজ। দারুণ ক্যাচে ৪০ বলে ২৫ রান করা মিরাজের বিদায় নিশ্চিত করলেন প্রামোদ মাদুশান। তার বিদায়ে ভাঙল মুশফিকের সঙ্গে গড়া ৪৮ রানের ষষ্ঠ উইকেট ম্যাচ বাঁচানো জুটিও।
এর আগে জবাব দিতে নেমে বিজয়কে নিয়ে ৫০ রানের জুটি গড়েন তামিম। অধিনায়ক দ্রুত ফিরে গেলে তাওহীদ হৃদয়ের সঙ্গে ৪৯ রানের জুটি গড়েন তিনি। আগের ম্যাচে ৯৬ রানে অপরাজিত থাকা হৃদয় অবশ্য এদিন নিজের ইনিংস বড় করতে পারেননি। ২২ রানে আউট হন তিনি। এই ধাক্কা সামলাতে এসে ১ রানেই ফিরেন অভিজ্ঞ মাহমুদুল্লাহ। তবে বিপর্যয় সামাল দেন মুশফিক ও মিরাজ। এই জুটি ভাঙার পর দলে আর কোনো বিপদে পড়তে দেননি রিশাদ। জুটি বাঁধেন অপরাজিত ৫৯ রানের। যেখানে মুশফিকের অবদান ১১ রান। শেষ পর্যন্ত দলের এই অভিজ্ঞ ব্যাটার ৩৬ বলে ৩৭ রান করে অপরাজিত থাকেন।
সিরিজে তিন ম্যাচে ৮ উইকেট নিয়ে বল হাতে শীর্ষে আছেন তাসকিন আহমেদ। তারপরেই আছেন ৬ উইকেট পাওয়া লঙ্কান বোলার হাসারাঙ্গা।