অনেক কষ্টে জামিন পেয়েছেন মো. ইউসুফ হোসেন। এবারের ঈদটা অন্তত পরিবার-পরিজন নিয়ে কাটাবেন এমন প্রত্যাশা স্বজনদের। কিন্তু এবারো পরিবারের সে ইচ্ছা পূরণ হচ্ছে না। জামিন পাওয়ার পরেও রাষ্ট্রপক্ষের ভুলের কারণে দীর্ঘ চার মাসেরও বেশি সময় ধরে কারাগারের চার দেয়াল থেকে বের হতে পারছেন না ইউসুফ। এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বরাবর আবেদন করেও কোনো লাভ হয়নি। সাড়া দেননি রাষ্ট্রপক্ষের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও এডভোকেট অন রেকর্ড। ঈদের পরে বিষয়টি দেখবেন বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষ। আসামির আইনজীবী বিষয়টি সুরাহা করতে এডভোকেট অন রেকর্ডকে ফোন করলে রোজার মধ্যে তিনি কোর্টে আসতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন। অথচ রাষ্ট্রপক্ষের কারণে দীর্ঘদিন ধরে জামিন পেয়েও কারাগারে আছেন ইউসুফ। গতকালও আসামির আইনজীবী মো. আশিকুর রহমান অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ে যোগাযোগ করেছেন।
কিন্তু এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তাতে কোনো কাজ হয়নি বলে তিনি জানান। এ বিষয়ে মানবাধিকার কর্মী ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না মানবজমিনকে বলেন, জামিন হওয়ার পরেও যদি কাউকে কারাগারে থাকতে হয়, সেটা হচ্ছে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন। এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষসহ সবাইকে আরও দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন।
ইউসুফের আইনজীবী আশিকুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, গত বছরের ৩১শে অক্টোবর আসামি মো. ইউসুফ হোসেনকে চাঁদপুরের জেলা ও দায়রা জজ আদালত জামিন প্রদান করেন। আদালতের রিলিজ আদেশ চাঁদপুর জেলা কারাগারে পৌঁছালে চেম্বার জজ আদালতের জামিল স্থগিতাদেশের কারণে কারা কর্তৃপক্ষ তাকে বের হতে দেয়নি। জামিন পাওয়ার পরেও মুক্তি না পেয়ে দীর্ঘ চার মাসেরও বেশি সময় ধরে ইউসুফ হোসেন জেল হাজতে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এটা ন্যায়বিচার পরিপন্থি। তিনি আরও বলেন, হাইকোর্টের জামিনের সময় রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এসএম গোলাম মোস্তফা তারা, চেম্বার কোর্টে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন সুজিত চ্যাটার্জি বাপ্পী ও এডভোকেট অন রেকর্ড ছিলেন সুফিয়া খাতুন। এ বিষয়ে ডিএজি গোলাম মোস্তফা তারা মানবজমিনকে বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে বিষয়টি খোঁজখবর নিয়ে সমস্যাটির সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হবে।
কারাগারে বন্দি ইউসুফের জামিন আদেশের নথিতে চাদপুরের বিচারক উল্লেখ করেন, হাজতি আসামি মো. ইউসুফ হোসেনের জামিনের আবেদন শুনানির জন্য নেয়া হলো। আসামি পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবী এবং বিজ্ঞ স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটরের বক্তব্য শুনলাম। শুনানিকালে আসামিপক্ষের বিজ্ঞ কৌঁসুলি নিবেদন করেন, আসামি সম্পূর্ণ নির্দোষ এবং কথিত ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়। এই আসামি ৩০/০৬/২০২২ খ্রি. হতে জেলহাজতে আছে। তিনি আসামিদের জামিনের প্রার্থনা করেন। রাষ্ট্রপক্ষের বিজ্ঞ স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর জামিনের বিরোধিতা করেন। উভয়পক্ষের বিজ্ঞ কৌঁসুলিগণের বক্তব্য শুনলাম। জামিনের দরখাস্ত ও নথি পর্যালোচনা করলাম। এটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী ২০০৩) এর ১১(ক)/৩০ ধারার মামলা। এই আসামির বিরুদ্ধে যৌতুকের দাবিতে মারধর করে ভিকটিমকে হত্যার অভিযোগ থাকলেও সুরতহাল ও বাদীর জবানবন্দি পর্যালোচনায় দেখা যায় ভিকটিমের দেহে ঘটনার সময় কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। ঘটনার পাঁচ মাস পরে বাদী এ মামলা করলেও তার সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যা নাই মর্মে আসামি শুনানি কালে উল্লেখ করেন। সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় ১০ হাজার টাকার বন্ডে বিজ্ঞ কৌঁসুলি ও স্থানীয় একজন জিম্মাদারের জিম্মায় পুলিশ রিপোর্ট দাখিল পর্যন্ত আসামির অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করা হলো। অতিসত্বর জামিননামা দাখিল করা হোক।
অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস বরাবর দেয়া আবেদনে ইউসুফ হোসেনের আইনজীবী মো. আশিকুর রহমান আবেদনে উল্লেখ করেন, মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগে ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ৪৯৮ ধারায় ক্রিমিনাল মিস কেস (৫৩৫০২/২০২২ নং) দায়ের করি। উক্ত মোকদ্দমায় আমি তিন আসামি মো. ইউসুফ হোসেন, মো. আবু তাহের ও মোসা. নার্গিস বেগমের জামিন আবেদন করি। আবেদনের শুনানি শেষে ২০২২ সালের ২৪শে অক্টোবর বিচারপতি মো. সেলিম এবং বিচারপতি মো. রিয়াজ উদ্দিন খানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আসামি মো. ইউসুফ হোসেনের নাম কর্তন পূর্বক দুই আসামি মো. আবু তাহের ও মোসা. নার্গিস বেগমকে জামিন মঞ্জুর করে আদেশ প্রদান করেন। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি/সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলগণ মামলার ১নং আসামি মো. ইউসুফ হোসেনের জামিনের আদেশ হয়েছে মর্মে ভুল বুঝিয়া হাইকোর্টের উক্ত আদেশের বিরুদ্ধে চেম্বার জজ আদালতে সি.এম.পি ফাইল করেন (সিএমপি ফাইল নং- ১৫০৫/২০২২)। পরে চেম্বার জজ ওই বছরের ২৬শে অক্টোবর ১নং আসামি মো. ইউসুফের জামিনের আদেশের ওপর স্থগিতাদেশ প্রদান করেন। অথচ বর্ণিত মোকদ্দমার আসামি মো. ইউসুফ হোসেনকে হাইকোর্ট জামিনই প্রদান করেননি।
আবেদনে আরও বলা হয়, গত বছরের ৩১শে অক্টোবর মো. ইউসুফ হোসেনকে এই মামলায় চাঁদপুরের জেলা ও দায়রা জজ আদালত জামিন প্রদান করেন। তার রিলিজ আদেশ চাঁদপুর কারাগারে পৌঁছালে চেম্বার জজ আদালতের জামিন স্থগিতাদেশের কারণে এখনো বের হতে পারেনি ইউসুফ।