সর্বশেষ
Home » অন্যান্য » ইসরাইল ইস্যুতে মুসলিম দেশ জর্ডান কেন ইসরাইলের পক্ষে!

ইসরাইল ইস্যুতে মুসলিম দেশ জর্ডান কেন ইসরাইলের পক্ষে!

ইসরাইল ইস্যুতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ জর্ডানের ভূমিকা নিয়ে সম্প্রতি বেশ কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, ইরান থেকে ইসরাইলের উদ্দেশ্যে যেসব ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছে তা প্রতিহত করতে যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেনের পাশাপাশি ইসরাইলের হয়ে কাজ করেছে জর্ডান।

গাজায় ইসরাইলের গণহত্যা নিয়ে সারা দুনিয়া যখন নিন্দা জানাচ্ছে, দামেস্কে ইরানের কন্স্যুলেটে বোমা হামলা করে যখন ইসরাইল রেভ্যুলুশনারি গার্ডের কমান্ডারসহ ৭ জনকে হত্যা করেছে- তখন কোন যুক্তিতে ইসরাইলের পক্ষ নিতে পারে জর্ডান? এমন প্রশ্ন সবার মাঝে। তবে বিবিসি বলছে, এক বিবৃতিতে জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ জানিয়েছেন, তারা নিজের দেশকে রক্ষা করার অংশ হিসেবে ইরানের ড্রোন ভূপাতিত করেছেন, ইসরাইলকে সাহায্য করার জন্য নয়। জর্ডানের এই বিবৃতিকে ‘ভারসাম্য রক্ষার’ বিষয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। কোনো কোনো পর্যবেক্ষক বলছেন- হামাস, ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে যে সংঘাত চলছে সেখানে ‘ক্রসফায়ারে’ পড়তে চায় না জর্ডান। বিবিসি আরও লিখেছে, একথা ঠিক যে, জর্ডানের রাজতন্ত্রের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। ২৫ বছর যাবৎ জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ।
পর্দার আড়ালে জর্ডানের সঙ্গে ইসরাইলের সম্পর্কও একেবারে খারাপ নয়। এক্সে ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের গবেষক এমিলি হোকায়েম বলেন, জর্ডান প্রমাণ করতে চেয়েছে তারা আমেরিকা এবং ইসরাইলের ভালো সহযোগী। কিন্তু এ বিষয়টি নেতানিয়াহুর কাছ থেকে আশা করা যাবে না। গাজায় হামলা বন্ধ এবং পশ্চিম তীর ও জেরুজালেমে উস্কানি বন্ধ করার জন্য আম্মানের আহ্বানে সাড়া দেবে না ইসরাইল। তবে ভিন্ন যুক্তিও আছে। ভৌগোলিকভাবে জর্ডানের অবস্থান এমন একটি অবস্থায় যে ইরান এবং ইসরাইলের মধ্যে কোনো যুদ্ধ শুরু হলে তার সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়বে জর্ডানের ওপর। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আটলান্টিক কাউন্সিলের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক ডেপুটি ডিরেক্টর মাসুদ মোস্তাজাবি একজন জর্ডানের নাগরিক। তিনি লিখেছেন, ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে এই উত্তেজনা যদি পুরোপুরি যুদ্ধে রূপ নেয় তাহলে এখন যাদের ইসরাইলের রক্ষাকর্তা বলে মনে করা হচ্ছে তারাও একসময় আক্রান্ত হবে এবং সেই যুদ্ধে তাদেরও টেনে আনা হবে। তিনি লিখেছেন, জর্ডানে বিপুল সংখ্যক ফিলিস্তিনি শরণার্থী, ভঙ্গুর অর্থনীতি এবং ঝুঁকিপূর্ণ ভৌগোলিক অবস্থান- এসব কিছুই তাদের জন্য চিন্তার কারণ। ১৯৯৪ সালে জর্ডান ও ইসরাইলের মধ্যে একটি শান্তি চুক্তি হয়, যার মাধ্যমে জর্ডান ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৭৯ সালে মিশর ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার পর জর্ডান ছিল স্বীকৃতিদানকারী দ্বিতীয় দেশ।

ইসরাইলের সংবাদপত্র টাইমস অব ইসরাইলে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, এ বছরের মার্চ মাসে জর্ডান এবং ইসরাইলের মধ্যে পানি চুক্তি নবায়ন করার জন্য জর্ডান ইসরাইলের প্রতি আহ্বান জানায়। কিন্তু এর বিপরীতে ইসরাইল জর্ডানকে পাল্টা শর্ত দিয়েছে। এই শর্ত হচ্ছে- গাজা ইস্যুতে জর্ডান যাতে খুব বেশি শক্ত অবস্থান না নিয়ে তাদের অবস্থান নরম করে। ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে আরেকটি চুক্তির আওতায় জর্ডান ইসরাইলের কাছে সৌর বিদ্যুৎ রপ্তানি করছে। পর্যবেক্ষকের অনেকেই বলছেন, জর্ডান প্রকৃতপক্ষে একটি ‘চিকন সুতোর’ উপর দিয়ে হাঁটছে। একদিকে আমেরিকা এবং ইসরাইলের সঙ্গে তাদের কৌশলগত সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা। কারণ, আর্থিকভাবে দুর্বল দেশ জর্ডান নানা ধরনের সহায়তার জন্য আমেরিকা এবং ইসরাইলের ওপর নির্ভর করতে হয়। অন্যদিকে ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখা। কারণ, জর্ডানের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক ফিলিস্তিনি শরণার্থী। শান্তি চুক্তি দ্য ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসি’র সিনিয়র ফেলো ঘাইথ আল-ওমারি দ্য টাইমস অব ইসরাইলকে বলেছেন, বেশ কয়েক বছর ধরে ইরান চেষ্টা করছে জর্ডানের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে। যেমনটা ইরান করেছে ইরাক, সিরিয়া, লেবানন এবং ইয়েমেনের ক্ষেত্রে। এসব দেশে ইরানের এক ধরনের রাজনৈতিক ও সামরিক প্রভাব তৈরি হয়েছে। ফলে এসব দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়ে গেছে। ইরান চেষ্টা করছে জর্ডানেও তাদের সে প্রভাব তৈরি করতে।

ইসরাইল যদি জর্ডানের আকাশসীমা ব্যবহার করে ইরানে আক্রমণ করে তাহলে সেটিকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে ইরান জর্ডানেও হামলা করতে পারে। এ বিষয়টি নিয়ে জর্ডান চিন্তিত। জর্ডান এবং ইসরাইলের মধ্যে নানা ধরনের রাজনৈতিক উত্তেজনা সত্ত্বেও সামরিক এবং গোয়েন্দা সহযোগিতা তখনো থেমে থাকেনি। মি. ওমারি বলেন, ইসরাইল এবং জর্ডান উভয় দেশ সামরিক ক্ষেত্রে পরস্পরের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারে। ১৯৯৪ সালে জর্ডান ও ইসরাইলের মধ্যে শান্তি চুক্তির পর থেকে দুই দেশের মধ্যে শক্ত নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সহযোগিতা তৈরি হয়েছে। মুসলিমদের পবিত্র এলাকা আল-আকসা মসজিদ কম্পাউন্ডের মোতওয়ালি বা কাস্টোডিয়ান হচ্ছে জর্ডান। শান্তিচুক্তি অনুযায়ী মাল্টি বিলিয়ন ডলার প্রজেক্টের মাধ্যমে ইসরাইল জর্ডানে গ্যাস ও পানি সরবরাহ করে। পৃথিবীর যেসব দেশে পানির তীব্র সংকট রয়েছে তার মধ্যে জর্ডান অন্যতম। জর্ডান চারপাশ থেকে স্থলসীমা বেষ্টিত। জর্ডানে বিক্ষোভ ইরানের প্রতিশোধমূলক আক্রমণ থেকে জর্ডান যেভাবে ইসরাইলকে সামরিক সহায়তা করেছে তাতে বেশ খুশি হয়েছে ইসরাইলিরা। ইসরাইলের সংবাদমাধ্যম বিশ্লেষণ করলে সে চিত্র দেখা যায়। টাইমস অব ইসরাইলের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, ইরানের হামলা রুখতে জর্ডান যেভাবে সহায়তা করেছে তাতে অনেক ইসরাইলিও বিস্মিত হয়েছে। কারণ, গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে ইসরাইলের চলমান যুদ্ধের কড়া সমালোচক হচ্ছে জর্ডান।

তারা ইসরাইলের সঙ্গে কূটনীতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য জর্ডানের সরকার দেশের ভেতরে জনগণের দিক থেকে বেশ চাপের মুখে আছে। তবে ইসরাইলের প্রতি জর্ডানের সামরিক সাহায্যের বিষয়টি একেবারে আকস্মিক কিছু নয় বলেও মনে করেন অনেকে। দ্য ওয়াশিংটন ইন্সটিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসি’র সিনিয়র ফেলো ঘাইথ আল-ওমারি দ্য টাইমস অব ইসরাইলকে বলেছেন- জর্ডান যেভাবে ইসরাইলকে সহায়তা করেছে তার মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে শক্ত নিরাপত্তা সহযোগিতার বিষয়টি প্রতিফলিত হয়েছে। ইতিহাস কী বলে? ইসরাইলের বিরুদ্ধে ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত মোট চারটি যুদ্ধে অংশ নিয়েছে জর্ডান। ১৯৯৪ সালে জর্ডান এবং ইসরাইলের মধ্যে শান্তিচুক্তি হয়। ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করা জাতিসংঘের সংস্থা ‘ইউএন রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্কস এজেন্সি ফর প্যালেস্টাইন রেফিউজিস ইন দ্য নিয়ার ইস্ট’-এর হিসাব মতে প্রায় ২২ লাখ ফিলিস্তিনি শরণার্থী জর্ডানে নিবন্ধিত আছে। কিন্তু নিবন্ধনের বাইরেও আরও অনেক ফিলিস্তিনি শরণার্থী জর্ডানে অবস্থান করছেন। সবমিলিয়ে এই সংখ্যা ৩০ লাখ কিংবা তার চেয়ে বেশি হতে পারে বলে ধারণা করা হয়। ১৯৫১ সালে জর্ডানের তৎকালীন বাদশাহ আবদুল্লাহ জেরুজালেমে আল-আকসা মসজিদে প্রবেশের সময় তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। একজন ফিলিস্তিনি আরব এই হত্যাকারী ছিলেন। বাদশাহ আবদুল্লাহকে ফিলিস্তিনিদের অনেকেই পছন্দ করতেন না।

এর একটি বড় কারণ ছিল প্রথম আরব-ইসরাইল যুদ্ধ এবং পরবর্তীতে ফিলিস্তিন নিয়ে তার ভূমিকা। শুধু তাই নয়, ১৯৭১ সালে জর্ডানের প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করেছিল ফিলিস্তিনি বন্দুকধারীরা। যদিও প্রথম আরব-ইসরাইল যুদ্ধে কয়েকটি প্রতিবেশী আরব দেশের সঙ্গে মিলে জর্ডান ও ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। জর্ডান যুদ্ধে অংশ নিলেও ভেতরে ভেতরে বাদশাহ আবদুল্লাহ ইসরাইলের সঙ্গে আঁতাত করেন। প্রথম আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর ১৯৫০ সালে জর্ডান তাদের সীমান্তের সঙ্গে ফিলিস্তিনি কিছু ভূখণ্ডকে জর্ডানের অন্তর্ভুক্ত করেছিল। বাদশাহ আবদুল্লাহ’র এই পদক্ষেপ পশ্চিমা দেশগুলো সমর্থন দিলেও ফিলিস্তিনিরা তা মানতে পারেনি। বাদশাহ আবদুল্লাহকে হত্যা করার পর মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ’র গোপন প্রতিবেদনে তাকে বৃটেনপন্থি হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। তখন সিআইএ’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাদশাহ আবদুল্লাহ’র হত্যাকাণ্ডের মধ্যদিয়ে কমিউনিস্ট বিরোধী এবং পশ্চিমাপন্থি একজন শাসকের অবসান হলো। তৃতীয় আরব-ইসরাইল যুদ্ধে অংশ নেয়ার বিষয়ে জর্ডানের কোনো আগ্রহ ছিল না। তখন জর্ডানের বাদশাহ ছিলেন হুসেইন। তার নীতি ছিল আরব জাতীয়তাবাদ এবং ইসরাইলের সঙ্গে সহাবস্থানের নীতি। যদিও ১৯৫৬ সালে সুয়েজ খাল সংকট নিয়ে জর্ডান ইসরাইলের বিরুদ্ধাচরণ করলেও পরবর্তীতে ইসরাইলের ব্যাপারে তিনি অনেকটা বাস্তববাদী অবস্থান গ্রহণ করেন। ১৯৬৩ সালে জর্ডানের বাদশাহ হুসেইন গোপনে আলোচনা শুরু করেন ইসরাইলি নেতাদের সঙ্গে।

ইরাকি বংশোদ্ভূত বৃটিশ-ইসরাইলি ইতিহাসবিদ আভি শ্লেইম ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস ইন দ্য মিডল ইস্ট’ বইতে লিখেছেন, ১৯৬৭ সালে ইসরাইল যখন জর্ডানে হামলা চালায় তখন জর্ডানও এই যুদ্ধে জড়িয়ে যায়। ফিলিস্তিনের ভূমিতে ইসরাইল এবং ফিলিস্তিনিদের জন্য আলাদা দুটি রাষ্ট্র গঠনের যে প্রস্তাব জাতিসংঘে উত্থাপিত হয়েছিল তাকে একমাত্র আরব দেশ হিসেবে সমর্থন দিয়েছিল জর্ডান। এর বিনিময়ে জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ অন্যান্য আরব ভূমি তাদের আওতায় আনতে চেয়েছিলেন। সেন্টার ফর ইসরাইল এডুকেশন বলছে ইসরাইল রাষ্ট্রের তৎকালীন প্রভাবশালী ইহুদি নেতা গোল্ডা মায়ার আম্মানে গিয়ে গোপনে বৈঠক করেছিলেন জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহর সঙ্গে। প্রথম আরব- ইসরাইল যুদ্ধের পর জর্ডান আনুষ্ঠানিকভাবে পশ্চিমতীর ও পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নেয়। সেখানে বসবাসরত ফিলিস্তিনি অধিবাসীদের জর্ডানের নাগরিকত্ব দেয়। সেন্টার ফর ইসরাইল এডুকেশনের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, এর আগে ইসরাইল এবং জর্ডানের মধ্যে বেশ কিছু গোপন বৈঠক হয় যুদ্ধবিরতি নিয়ে। আরব লীগের অন্যান্য দেশ জর্ডানের এসব কর্মকাণ্ড তখন মেনে নিতে পারেনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *