একটি ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিপ্লব বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান দমনমূলক শাসনের অবসান ঘটিয়েছে গত ৫ই আগস্ট। টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিানার পতন হয়েছে। যার মাধ্যমে একটি নতুন যুগের সম্ভাবনা তৈরি করেছে তরুণরা। তারা গণতন্ত্রের জয় ছিনিয়ে এনেছে। তবে এতে সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হলেও সার্বিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করা সময় সাপেক্ষ। যে বিপ্লব ছাত্র-জনতা সাধন করেছে তা এখনও বিপ্লবী হয়ে উঠতে সময় লাগবে বলে মনে করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড স্টেট ইনস্টিটিউট অব পিস। ১৯ আগস্ট ‘বাংলাদেশ’স রেভ্যুলিউশন রিমেইনস আনফিনিশড’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ওই প্রতিষ্ঠান।
সেখানে বলা হয়ছে, বাংলাদেশের বিপ্লবী মুহূর্ত এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। গণতন্ত্র এবং রাজনৈতিক সংস্কারের দীর্ঘ যে জার্নি এই বিপ্লবের মাধ্যমে তরুণরা শুধুমাত্র তার দ্বার উন্মোচন করেছে। শেখ হাসিনার অধীনে বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়েছে সে পথেই আগানোর চেষ্টা চালাতে পারে পরবর্তী সরকারগুলো। হাসিনা শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, দ্রুত অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শ্রমবাজারে নারীদের ক্রমবর্ধমান কাজের সুযোগ সৃষ্টিতে আগের সরকারের তুলনায় ভালো পরিসংখ্যান অর্জন করেছিলেন।
পররাষ্ট্রনীতিতে তিনি প্রায়শই আঞ্চলিক প্রতিযোগী ভারত ও চীনের মধ্যে ভারসাম্যের কাজটি দক্ষতার সাথে পরিচালনা করার চেষ্টা করেছিলেন। পরিসংখ্যানগত এই সাফল্যের পেছনে যে অন্ধকার বাস্তবতা লুকিয়ে আছে তা এখন গুরুত্বের সাথে স্পষ্ট হওয়া জরুরি। দুর্নীতি ও বৈষম্য বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। শ্রমবাজারে তৈরি হয়েছে অস্থিরতা। আওয়ামী লীগের আমলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্নীতিগ্রস্ত করা হয়েছে। গোটা দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা ক্রমবর্ধমান অগণতান্ত্রিক আচরণে দুর্বল হয়ে পড়েছে। বিরোধী দল দমনে গুম, খুনের পথে অবিচল ছিলেন শেখ হাসিনা।
হাসিনার দেশ ত্যাগ করার পর নানা বৈরি অবস্থার মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এখন তার দায়িত্ব হচ্ছে বাংলাদেশের বিপ্লবি ভাবাদর্শকে চিরস্থায়ী করা। দেশের ইতিবাচক উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখা এবং সামাজিকভাবে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করা। গত ১৫ বছরের ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দুর্নীতির ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসা। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। সমঝোতা এবং ঐক্যমত প্রতিষ্ঠায় ড. ইউনূসকে বিশাল ভূমিকা পালন করতে হবে। এছাড়া সার্বিকভাবে দুর্বল অর্থনীতিকে একটি স্থিতিশীল পর্যায়ে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন।
যদিও ড. ইউনূসের জন্য এ পথ বেশ চ্যালেঞ্জের। কেননা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুনরায় ইতিবাচক ধারায় নিয়ে আসা এবং নতুন একটি ইতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা অবশ্যই একটি বিশাল কাজ। বিশেষ করে একটি অনির্বাচিত সরকার হিসেবে এ জন্য যে সময় দরকার তা অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে থাকে না। শুধুমাত্র একটি দেশের প্রধানকে ক্ষমতাচ্যুত করে সেখানের সকল কিছুতে পরিবর্তন নিয়ে আসা সম্ভব নয়। কেননা তার হাতে ছিল বিশাল আমলা বাহিনী। যার প্রতিটি বিভাগের ভিন্ন ভিন্ন এজন্ডা থাকে। মূলত আমলাদের হাতেই একটি সরকারের স্থায়ীত্ব নির্ধারিত হয়। এক্ষেত্রে তাদের স্বার্থান্বেষী কর্মকাণ্ড একটি দেশের ইতিবাচক পরিবর্তনে বিশাল বাধা হতে পারে। বাংলাদেশে যদি অচলাবস্থা ও স্বার্থান্বের্ষী স্বার্থ সচল থাকে তাহলে তা দেশকে ভবিষ্যতে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। বৈধ শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য নির্বাচনের প্রয়োজন কিন্তু যদি উপযুক্ত সময়ের আগে তা অনুষ্ঠিত হয় তাহলে আগে থেকে প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাই আবার সক্রিয় হতে পারে। যদি এমন হয় তাহলে বাংলাদেশের তরুণদের পুনরায় পরবর্তী সরকার উৎখাতে আন্দোলনে নামতে হবে যাতে দেশ আবার আগের স্থানে নেমে আসবে। হাসিনার পতনের পর যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তার সমাধান না হলে বাংলাদেশে দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাড়ার শঙ্কাই বেশি।
এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দিকটাও গুরুত্বপূর্ণ। নিজেদের দীর্ঘ পারস্পারিক সম্পর্কে দিল্লির নিরাপত্তা, বাণিজ্য ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করে আওয়ামী লীগকে প্রধান মিত্র হিসেবে বিশ্বাসের জায়গায় স্থান দিয়েছে ভারত। বিনিময়ে দেশটি বিতর্কিত নির্বাচন এবং মানবাধিকার সংক্রান্ত উদ্বেগের মধ্যেও হাসিনার পাশে দাঁড়িয়েছিল। কার্যত আওয়ামী লীগের প্রতি দিল্লির এমন সমর্থনের ফলেই হাসিনার শেষ পর্যন্ত এমন পরিণতি হয়েছে। কেননা ভারতের সমর্থনে হাসিনা নিজ দেশের জনগণের বিশ্বাস হারিয়েছেন। পাশাপাশি বাংলাদেশে দিল্লি বিরোধীতারও নতুন একটি রূপ পেয়েছে। চীনও তার অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে হাসিনাকে নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে সমর্থন করেছে। উভয় দেশই এক্ষেত্রে বাংলাদেশের জনগণের তুলনায় ক্ষমতাকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছে। শেখ হাসিনার প্রতি এমন সমর্থনের কারণে উভয় দেশই বেশ সমালোচিত।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ না হলেও গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থের ঝুঁকিতে রয়েছে। কেননা পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গন্তব্য এবং দেশের প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের মূল উৎস। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহায়তার জন্য যুক্তরাষ্ট্র প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। হাসিনার অধীনে বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের রেকর্ড খারাপ হওয়া সত্ত্বেও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাবেক সরকারের সাথে শক্তিশালী নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সম্পর্ক বজায় রেখেছিল এবং আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশকে একটি উদীয়মান কৌশলগত অংশীদার হিসাবে দেখেছিল। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক বিশ্বের সাথে রাজনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে বেশ সতর্ক হতে হবে।
(ইউনাইটেড স্টেট ইনস্টিটিউট অব পিসের ওয়েবসাইট থেকে নেয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: আব্দুল কাইয়ুম)