বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ৫ জনকে হত্যার অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুলসহ ১৯৮ জনের বিরুদ্ধে আরও পাঁচটি মামলা হয়েছে। আজ ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এই পাঁচটি মামলা দায়ের করা হয়। এরমধ্যে যাত্রাবাড়ী, আদাবর, সূত্রাপুর, রামপুরা ও মিরপুর থানায় একটি করে মামলা করা হয়েছে। পুলিশকে মামলাগুলো এজাহার হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দেন আদালত। এ নিয়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ঢাকায় ১৭টি মামলা হলো। এরমধ্যে হত্যার অভিযোগে ১৬টি এবং অপরটি গুম ও অপহরণের অভিযোগে।
ফল বিক্রেতা ফরিদ হত্যা মামলা: রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে হানিফ ফ্লাইওভারের টোলপ্লাজায় ফলের দোকানি ফরিদ শেখকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলসহ ২১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। মঙ্গলবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শাকিল আহম্মেদের আদালতে মামলাটি করা হয়। নিহত যুবক ফরিদ শেখের বাবা সুলতান মিয়ার জবানবন্দি গ্রহণ করে আদালত পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন। মামলার অন্য আসামিরা হলেন- সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক আবদুল্লাহ আল মামুন, ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলাম, সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ, অতিরিক্ত যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার, সাবেক কমিশনার ডিএমপি হাবিবুর রহমান, জাসদের হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন, ১৪ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ. আরাফাত, যাত্রাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল হাসানসহ অজ্ঞাতনামা ২৫০ জন।
মামলার অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ৪ঠা আগস্ট বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে আন্দোলন চলাকালে ফরিদ শেখ যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের টোলপ্লাজার দক্ষিণ পাশের রাস্তা দিয়ে তার ফলের দোকানে যাচ্ছিলেন। এ সময় শেখ হাসিনার নির্দেশে গণহত্যা চালানোর সময় পুলিশের গুলির আঘাতে মারাত্মক জখম হয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন।
আশপাশের লোকজন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাকে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। ফরিদ শেখের পাকস্থলির ডান পাশে লেগে বাম পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায় গুলি। মুগদা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৬ই আগস্ট সকাল ১১টা ৪৫ মিনিটে ফরিদ শেখ মারা যান।
গার্মেন্টকর্মী সোহেল রানা হত্যা মামলা: গার্মেন্টকর্মী সোহেল রানাকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে করা মামলায় শেখ হাসিনাসহ ২৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। নিহতের ভাই ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সুলতান সোহাগ উদ্দিনের আদালতে এ মামলার আবেদন করেন। আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে ঢাকার আদাবর থানা পুলিশকে মামলাটি এজাহার হিসেবে গ্রহণের আদেশ দেন। এ মামলার অন্য আসামিরা হলেন- সাবেক সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন, যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ, যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল ইসলাম খান নিখিল, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মো. সাদ্দাম হোসেন, সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালি আসিফ ইনান, সাবেক ডিবিপ্রধান হারন অর রশিদ, সাবেক যুগ্ম কমিশনার (অপারেশন) বিপ্লব কুমার সরকার, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় আদাবর থানা এলাকায় স্বৈরশাসকের এজেন্ডা বাস্তবায়নকারী পুলিশ, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ অন্যান্য সন্ত্রাসী তথা আসামিরা এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে। ভিকটিমসহ ঘটনাস্থলে আসামিদের গুলিতে একাধিক নিহত ও অনেকেই আহত হন। এ সময় গুলিবিদ্ধ হলে ভিকটিম সোহেল রানাকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। মামলার অভিযোগে আরও বলা হয়, হাসপাতালে চিকিৎসক সংকট ও পুলিশ না থাকায় হাজার হাজার আহত ও শত শত নিহত রোগীর মধ্যে ভিকটিম সোহেল রানার পোস্টমর্টেম করতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অপরাগতা প্রকাশ করে। পরে ভিকটিমের ভাই ও আত্মীয়স্বজন ভিকটিমকে বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করতে চাইলে কবরস্থান কর্তৃপক্ষ পোস্টমর্টেম রিপোর্ট না থাকায় দাফনে অনিহা প্রকাশ করে। এরপর বাদী তার নিহত ভাইকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি ভোলা জেলার দেউলা গ্রামের স্থানীয় ঠিকানায় দাফন সম্পন্ন করেন।
কলেজছাত্র ওমর ফারুক হত্যা মামলা: ১৯ শে জুলাই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় রাজধানীর লক্ষ্মীবাজার এলাকায় গুলিতে সরকারি কবি নজরুল কলেজের ছাত্র ওমর ফারুক হত্যার ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ ৪৯ জনকে আসামি করা হয়েছে। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তরিকুল ইসলামের আদালতে মামলার আবেদন করেন নিহতের মা কুলছুমা আক্তার। এ সময় আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে সূত্রাপুর থানা পুলিশকে অভিযোগটি এজাহার হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দেন। এ মামলায় অন্য আসামিরা হলেন- সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রমুখ।
শিশু তামীম হত্যা মামলা: রাজধানীর রামপুরা এলাকায় শিশু তামীম শিকদারকে (১৩) গুলি করে হত্যার অভিযোগে করা মামলায় শেখ হাসিনাসহ ৮৪ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আফনান সুমীর আদালতে মামলার আবেদন করেন নিহতের দাদি মোছা. কোহিনূর। আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে রামপুরা থানাকে মামলাটি এজাহার হিসেবে গ্রহণের আদেশ দেন। এ মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়াও উল্লেখযোগ্য আসামিরা হলেন- সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক এমপি মো. ওয়াকিল উদ্দিন, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মো. হাছান মাহমুদ সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মো. আলী আরাফাত প্রমুখ। মামলার অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ১৯শে জুলাই ডিআইটি রোডে পুলিশ হাজার হাজার ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। এ সময় শিশু তামীম শিকদার রাস্তা পার হয়ে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। বুলেট তার বুকের ডান পাশ দিয়ে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। পরে তার দাদি স্থানীয়দের সহায়তায় ভিকটিমকে বনশ্রীর ফরাজী হাসপাতালে নিয়ে আসলে দায়িত্বরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
বিইউবিটি’র শিক্ষার্থী সুজন হত্যা মামলা: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুজন মাহমুদকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় করা মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৮ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়েছে। আজ ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. মেহেদী হাসানের আদালতে এ মামলার আবেদন করেন নিহতের ভাই সুলতান মাহমুদ। আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে মামলাটি এজাহার হিসেবে গ্রহণ করার জন্য মিরপুর মডেল থানা পুলিশকে আদেশ দেন। শেখ হাসিনা ব্যতীত এ মামলার উল্লেখযোগ্য আসামিরা হলেন- আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইনমন্ত্রী মো. আনিসুল ইসলাম, সাবেক মন্ত্রী আমির হোসেন আমু, সাবেক এমপি রাশেদ খান মেনন, সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সাবেক এমপি নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী, সাবেক এমপি দিলীপ বড়ুয়া, সাবেক এমপি আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, সাবেক মৎস্য ও পানিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল, সাবেক মন্ত্রী কামাল আহম্মেদ মজুমদার ও সাবেক এমপি ইলিয়াস মোল্লা। মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, গত ৫ই আগস্ট সরকার পতনের দাবিতে বিক্ষোভ চলাকালে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে গুলিবিদ্ধ হন সুজন মাহমুদ। এরপর তাকে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে দায়িত্বরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।