গত ৫ই আগস্ট সরকার পতনের পর গণভবন, সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সঙ্গে হামলা চালানো হয় রাজধানীর বিভিন্ন থানায়। সে সময় নিজেদের জীবন বাঁচাতে অস্ত্র-পোশাক থানায় রেখেই আত্মগোপনে চলে যায় মোহাম্মদপুর থানার পুলিশ সদস্যরা। সে সময় শত শত মানুষ থানায় ঢুকে সাত শতাধিক ছোট-বড় অস্ত্র, গোলাবারুদ, আসবাবপত্র, মোটরসাইকেলসহ থানায় রক্ষিত সবকিছু লুট করে আগুন ধরিয়ে দেয়। ঘটনার দেড় মাসে ছোট-বড় মিলিয়ে উদ্ধার হয়েছে মাত্র ১১০টি আগ্নেয়াস্ত্র। অভিযোগ উঠেছে-জেনেভা ক্যাম্পের মাদক নিয়ে চলা দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ব্যবহৃত হচ্ছে থানা থেকে লুট হওয়া পুলিশের এসব আগ্নেয়াস্ত্র। এসব বন্দুকের গুলিতে এখন পর্যন্ত দুইজন নিহতসহ আহত হয়েছেন অর্ধশত মানুষ।
বাংলাদেশে ১১৫টি উর্দুভাষী ক্যাম্পের মধ্যে অন্যতম রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প। তবে সরকার পতনের পর থেকে এই ক্যাম্পের অভ্যন্তরে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে ভূঁইয়া সোহেল ও চুয়া সেলিম বাহিনী নামে দুটি পক্ষ। এই সোহেলের সঙ্গে আছে চিহ্নিত মাদক কারবারি রানা, কালীন জাম্বু, টুনটুন, কালু, আনোয়ার। আর চুয়া সেলিমের বাহিনীতে রয়েছে আকরাম, শাহ আলম, সোহেল, জানু, আরমানসহ বেশ ক’জন সক্রিয় সদস্য। এদের সঙ্গে মাদক ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে এ সংঘর্ষে যোগ দিয়েছে জেনেভা ক্যাম্পের বিখ্যাত ‘বোবা বিরিয়ানি’ এর মালিকের ভাই কামরান এবং তার ছেলে ইরফান। এরা সকলেই জেনেভা ক্যাম্পের শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী। মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়েই তাদের এই দ্বন্দ্ব। তবে এতদিনেরে দা-বঁটি ও লাঠিসোটা নিয়ে চলা সংঘর্ষে এবার যোগ হয়েছে শটগান, শুটারগান, পিস্তলসহ বিভিন্ন ধরনের ছোট-বড় আগ্নেয়াস্ত্র। পান থেকে চুন খসলেই আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে তারা। মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দা মোহাম্মদ মিন্টু বলেন, সরকার পতনের পর থেকে মাদক ব্যবসা ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ক্যাম্পে গোলাগুলির ঘটনা নিত্যদিনের হয়ে গেছে। আগে এসব সংঘর্ষে দা-ছুরি, বঁটি, লাঠিসোটা ব্যবহার হলেও আগস্টের পাঁচ তারিখের পর থেকে বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে। মূলত থানা থেকে লুট করা হয় এসব অস্ত্র। আবার আন্দোলনের সময় স্থানীয় কাউন্সিলর সৈয়দ হাসানুর ইসলাম রাস্টন ক্যাম্পের মাদক ব্যবসায়ীদের হাতেও কিছু অস্ত্র তুলে দিয়েছিলেন। এখন নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য সেসব অস্ত্র ব্যবহার করছে ক্যাম্পের বাসিন্দারা। তিনি বলেন, ৫ তারিখে হাসিনা চলে গেল। আর এর পরদিন ৬ই আগস্টে দুই গ্রুপের গোলাগুলিতে নিহত হন ক্যাম্পের বাসিন্দা শাহেন শাহ্। আর সেপ্টেম্বরের ৪ তারিখে মারা যান ক্যাম্পের বাবুল হোসেনের ছেলে অটোরিকশাচালক মোহাম্মদ সনু। প্রতিদিনই কেউ না কেউ গুলিতে আহত হচ্ছেন। আমি নিজেও গুলিবিদ্ধ হয়েছি। তিনি বলেন, গত ২৯শে আগস্ট বাসা থেকে বের হয়ে দোকানে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ করে ভূঁইয়া সোহেল ও চুয়া সেলিম বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। দু’গ্রুপই গুলি ছোড়া শুরু করে। তাদের ছোড়া শটগানের ছররা গুলি আমার গায়ে এসে লাগে। সেদিন আমি মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে এসেছি।
নিহত সনুকে সেদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া তার প্রতিবেশী সাজিদ, শামীম ও সজীব আহমেদ বলেন, মাদক কারবারি হিসেবে বুনিয়া সোহেলকে জেনেভা ক্যাম্পের সবাই চিনে। সেদিন সকাল ৮টার দিকে সনু ভাই সোহেলকে বলেন, তুমি মাদক বিক্রি করছো, এতে এখানকার ছেলেরা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে দু’জনের মধ্যে তর্কাতর্কি শুরু হয়। একপর্যায়ে সোহেলসহ কয়েকজন সনুর ওপর চড়াও হয়। সোহেল সনুর ওপর গুলি চালান। সেই গুলি সনুর বুকে এসে লাগে। শাওন নামে আরও একজনের গায়ে গুলি লাগে। তখন আমরা তাদেরকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে গেলে চিকিৎসক সনু ভাইকে মৃত ঘোষণা করেন। তারা বলেন, ক্যাম্পে যেসব আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে এসবই থানা থেকে লুট করা অস্ত্র। গোলাগুলির সময় পুলিশের বিশেষ পোশাক পরা অবস্থায়ও অনেককে দেখা গেছে।
সরজমিন জেনেভা ক্যাম্পে গিয়ে জানা গেছে, মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে প্রায় ৪৫ হাজার মানুষের বসবাস। এরা সকলেই অবাঙালি। তারা নিজেদের মধ্যে এক ভাষায় কথা বলেন। আর অন্যদের সঙ্গে বাংলা ভাষায় কথা বলেন। রাজধানীর সেলুনে চুল কাটাসহ নিম্নমানের কাজ করে তারা জীবিকা নির্বাহ করলেও অনেকেই আবার ক্যাম্পকে মাদকের অভয়ারণ্য হিসেবে ব্যবহার করছেন। ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজা, ফেনসিডিল এমন কিছু নেই সেখানে পাওয়া যায় না। রাত-দিন চব্বিশ ঘণ্টাই ক্যাম্পে চলে মাদকের জমজমাট বেচা-কেনা। আর এই মাদক বেচা-কেনা নিয়েই চলে নিত্যদিনের সংঘর্ষ। গত এক মাসে মাদক নিয়ে চলা এই গোলাগুলিতে দু’জন নিহতসহ শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। শামীম হোসেন নামে ক্যাম্পের এক বাসিন্দা বলেন, শুধু ক্যাম্প না, ক্যাম্পের আশপাশে যত ইয়াবা সিন্ডিকেট আছে সব ভূঁইয়া সোহেল ও চুয়া সেলিম বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করছে। ওদের অনেক ক্ষমতা এরপর তাদের কাছে থানা ও সংসদ ভবন থেকে লুট করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভারী অস্ত্র রয়েছে। তারা নিরীহ লোকদের রাস্তা থেকে ধরে এনে নানাভাবে নির্যাতন করে টাকা আদায় করছে। এদের অত্যাচারে আশপাশের বাসিন্দারাও অতিষ্ঠ। মিরাজুল ইসলাম নামে মোহাম্মদপুরের হুমায়ুন রোডের এক বাসিন্দা বলেন, এসব মাদক কারবারিদের অনেক ক্ষমতা। তাদের কাছে অস্ত্র আছে। তাই কেউ তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে সাহস পাই না। আমরা চাই সেনা অভিযানের মধ্যদিয়ে এখানকার মাদক কারবারিদের নির্মূল করা হোক। জেনেভা ক্যাম্পে একটা সেনা অভিযান খুবই প্রয়োজন। জুয়েল রানা নামে বাবর রোডের এক বাসিন্দা বলেন, আমাদের বাচ্চারা ছোট থেকেই এই ক্যাম্পের মাদক বেচা-কেনা দেখে বড় হচ্ছে। তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা সকলে চিন্তিত। তাই এই জেনেভা ক্যাম্পে সেনাবাহিনীর সদস্যদের নিয়ে একটি যৌথ অভিযান খুবই প্রয়োজন।
এ বিষয়ে মোহাম্মদপুর থানার অস্ত্রাগারের দায়িত্বে থাকা এসআই সাদিক বলেন, গত ৫ই আগস্ট আমাদের থানায় হামলার সময় সরকারি-বেসরকারি মিলে ছোট বড় অন্তত সাত শতাধিক অস্ত্র লুট করা হয়। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত ১১০টির মতো অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি অস্ত্রের হদিস এখনো পাওয়া যায়নি। একটি থানায় এত অস্ত্র কীভাবে এলো- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের মোহাম্মদপুর থানা অনেক বড় এলাকা জুড়ে। বিভিন্ন সময় অনেকে তাদের লাইসেন্সকৃত অস্ত্র জমা দিয়েছেন। বিভিন্ন অভিযানের মাধ্যমে আমরা অনেক অস্ত্র উদ্ধার করেছিলাম। আমাদের থানার পুলিশ সদস্যদের জন্যও প্রায় দেড় শতাধিক অস্ত্র বরাদ্দ ছিল। সবমিলে প্রায় সাত শতাধিক অস্ত্র ছিল থানায়।
বিষয়টি নিয়ে মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলী ইফতেখার হাসান বলেন, গত মাসখানেক ধরে চলা জেনেভা ক্যাম্পের গোলাগুলির বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। আমরা অস্ত্রধারীদের তালিকা সংগ্রহের চেষ্টা করছি। কিছু নামও পেয়েছি।