সাভারের আশুলিয়ায় বন্ধ কারখানা খুলে দেয়া ও সার্ভিস বেনিফিটসহ ক্ষতিপূরণের দাবিতে শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষের ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে এক শ্রমিক মারা গেছেন। এ ঘটনায় রাসেল মিয়া, হাবিব, নাজমুল হাসান ও নয়ন নামে আরও ৪ জন শ্রমিক গুলিবিদ্ধ ও অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন। গতকাল দুপুরে আশুলিয়ার টঙ্গাবাড়ি এলাকার মণ্ডল নিটওয়্যার কারখানার সামনে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ৫১ জনকে আটক করেছে পুলিশ। নিহত শ্রমিকের নাম কাউসার আহাম্মেদ (২৬)। সে টঙ্গাবাড়ি এলাকার ম্যাংগো টেক্স লিমিটেড কারখানায় সুইং অপারেটর হিসেবে কাজ করতো।
বিষয়টি নিশ্চিত করে এনাম মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. এনামুল হক মিয়া বলেন, নিহত শ্রমিকের তলপেটের বামপাশে গুলি লেগেছে। তাকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। বাকিদের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। তাদের মধ্যে একজনকে আইসিইউতে, একজনকে সার্জারি বিভাগে ভর্তি করা হয়েছে। নয়ন নামের একজনের বুকের ডান পাশে গুলি লেগে বের হয়ে গেছে এবং রাসেলের বুকে এবং পেটে দু’টি গুলি লেগে পেছন দিয়ে বের হয়ে গেছে। সকালে আশুলিয়ার টঙ্গাবাড়ি এলাকার মণ্ডল নিটওয়্যার কারখানার শ্রমিকরা বন্ধ কারখানা খুলে দেয়ার দাবিতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনায় বসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এদিকে ভেতরে বৈঠক চলাকালে বাহিরে থাকা শ্রমিকরা ভেতরের শ্রমিকদের আটকে রাখার গুজব ছড়ায়। এ খবর আশপাশের কারখানায় ছড়িয়ে পড়লে পার্শ্ববর্তী ম্যাঙ্গো টেক্স ও ন্যাচারাল ডেনিমস কারখানার শ্রমিকরা একযোগে মণ্ডল নিটওয়্যার কারখানায় হামলা চালায়। এ সময় দায়িত্বরত পুলিশসহ যৌথ বাহিনীর সদস্যরা শ্রমিকদের বুঝিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা এ সময় শিল্প পুলিশের উপর হামলা চালায় এবং র্যাব ও সেনাবাহিনীর বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করে। হামলায় শিল্প পুলিশের এসপি সারোয়ার আলম গুরুতর আহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পরে শ্রমিকরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করলে পুলিশ বেশ কয়েক রাউন্ড টিয়ারশেল রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে।
এ সময় উভয় পক্ষের মধ্যে ঘণ্টাব্যাপী চলা সংঘর্ষে পুলিশসহ অর্ধশতাধিক মানুষ আহত হন। এদের মধ্যে তিনজনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় সাভার এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক কাউসারকে মৃত ঘোষণা করেন। এদিকে উভয় পক্ষের সংঘর্ষ চলাকালে জিরাবো-আশুলিয়া সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশসহ যৌথ বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করা হয়েছে। অন্যদিকে সকাল ১০টার দিকে সার্ভিস বেনিফিট ও ক্ষতিপূরণ প্রদানসহ বন্ধ কারখানা খুলে দেয়ার দাবিতে প্রায় ৫ ঘণ্টা আশুলিয়ায় নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের বাইপাইল ও ডিওএইচএস পয়েন্টে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে ডংলিয়ন ও বার্ডস গ্রুপের শ্রমিকরা। শ্রমিকরা জানান, গত ২৭শে আগস্ট এক নোটিশের মাধ্যমে বার্ডস গ্রুপ লে-অফ ঘোষণা করে নোটিশ দেয়। নোটিশে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে কারখানায় কাজ না থাকায় অব্যাহতভাবে আর্থিক লোকসানের মধ্যদিয়ে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করার কথা জানায়। নোটিশে ২৮শে আগস্ট থেকে গ্রুপটির আর এন আর ফ্যাশনস লিমিটেড, বার্ডস গার্মেন্টস লিমিটেড, বার্ডস ফেডরেঙ লিমিটেড এবং বার্ডস এ অ্যান্ড জেড লিমিটেডের সকল শাখার কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
তারা জানান, তাদের আগস্ট মাসের বেতন সেপ্টেম্বরের ১০ তারিখ এবং ৩০শে সেপ্টেম্বর সার্ভিস বেনিফিটসহ ক্ষতিপূরণ পরিশোধের দিন ধার্য করা হয়। চুক্তিমতো শ্রমিকদের বেতনের টাকা পরিশোধ করলেও ৩০শে সেপ্টেম্বর সার্ভিস বেনিফিটসহ ক্ষতিপূরণের টাকা প্রদানের জন্য রোববার নতুন করে আরও তিন মাস সময় চেয়ে নোটিশ দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। পরে নির্ধারিত সময়ে টাকা পরিশোধ না করায় শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শ্রমিক নেতা বলেন, ৩০শে সেপ্টেম্বর শ্রমিকদের নির্ধারিত পাওনাদি পরিশোধের কথা ছিল। এই তারিখ পিছিয়ে আরও তিন মাস সময় চান কর্তৃপক্ষ। শ্রমিকদের বুঝিয়ে এই তিনমাস সময় নিয়ে দিতে শ্রমিক নেতারা ২০ লাখ টাকা দাবি করেন কারখানা কর্তৃপক্ষের কাছে। পরে ১২ লাখ টাকায় রফা দফা হয়। রোববার ৪ শ্রমিক নেতা কারখানার আইনজীবী ‘আমেনার’ সঙ্গে মিটিং করার পর বার্ডস গ্রুপের পক্ষ থেকে তিন মাস সময় চেয়ে একটি নোটিশ দেয়। নোটিশের খবর শ্রমিকদের মাঝে ছড়িয়ে পড়লে শ্রমিকরা উত্তেজিত হয়ে সড়ক অবরোধ করে। এ ছাড়া ডংলিয়ন পোশাক কারখানার শ্রমিকরা জানায়, কয়েকদিন পর পর কারখানা কর্তৃপক্ষ ১৩ (১) ধারায় বন্ধ ঘোষণা করে। এ পর্যন্ত প্রায় ৩বার কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে। গতকাল থেকে আবার কারখানা বন্ধের নোটিশ দেয়ায় বন্ধ কারখানা খুলে দেয়ার দাবিতে সড়ক অবরোধ করে শ্রমিকরা। এর আগে সকালে জিরাবো পুকুরপাড় এলাকার বন্ধ থাকা লুসাকা গ্রুপের বেক নিট লিমিটেড ও তাম্মাম ডিজাইন লিমিটেড কারখানার সামনে গিয়ে দেখা যায় যৌথবাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য বিশমাইল জিরাবো সড়কের উভয় পাশে কঠোর অবস্থানে রয়েছেন। তবে পাশেই অবস্থিত অ্যাকটিভ কম্পোজিট মিলস লিমিটেড কারখানায় শান্তিপূর্ণভাবে কাজ করছে শ্রমিকরা।
লুসাকা গ্রুপের সুইং অপারেটর আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, দাবি আদায়ে আন্দোলন করায় মালিকপক্ষ আমাদের শ্রমিকদের নামে মামলা করে কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে। প্রতিদিন আমরা কাজ করার জন্য কারখানার সামনে এসে ঘুরে যাই কিন্তু মালিক কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সমস্যা সমাধানে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো আমাদের ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেয়। তাম্মাম ডিজাইন লিমিটেড কারখানার সুইং অপারেটর সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, আমরা কারখানায় কাজ করতেই আসি। কিন্তু আমাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে। আমাদের রুটি রুজির ব্যবস্থা বন্ধ করে রাখা হয়েছে। অন্য কারখানায় শ্রমিকরা ভাঙচুর করলেও আমরা শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করেছি। আমাদের কারখানা খুলে দেয়া হোক আমরা কাজ করতে চাই। চালু থাকা রাইজিং গ্রুপের অ্যাকটিভ কম্পোজিট মিলস লিমিটেড কারখানার এইচআর এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. তৌহিদুজ্জামান বলেন, সরকার এবং বিজিএমইএ’র নির্দেশনা অনুযায়ী আমাদের সকল দাবি মেনে নেয়ায় আমাদের শ্রমিকরা শান্তিপূর্ণভাবে কাজ করছে। কিন্তু পাশের বন্ধ থাকা লুসাকা গ্রুপের শ্রমিকরাসহ বহিরাগত লোকজন এসে গেটে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে ভাঙচুর চালায়। তখন বাধ্য হয়েই কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়। আশুলিয়া শিল্প পুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার সারোয়ার আলম জানান, সকাল থেকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে তৈরি পোশাক শ্রমিকরা শান্তিপূর্ণভাবে কাজ করছে। দুপুরের দিকে মণ্ডল নিটওয়্যার কারখানার শ্রমিকদের আলোচনা করার সময় পার্শ্ববর্তী ম্যাঙ্গো টেক্স ও ন্যাচারাল ডেনিম কারখানার শ্রমিকরা আমাদের উপর হামলা করলে তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জসহ টিয়ারশেল নিক্ষেপ করা হয়। এর বাইরে শ্রম আইনের ১৩ (১) ধারায় ১১টি কারখানা বন্ধ আছে এবং ৭টি কারখানায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে শিল্প পুলিশ, এপিবিএনসহ সেনাবাহিনীর সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন বলেও জানান তিনি। এদিকে, ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি মোস্তাফিজুর রহমান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি সেনাবাহিনী ও পুলিশের ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ি ও কারখানা পরিদর্শন শেষে ভিডিও ফুটেজ দেখে দোষীদের বিরুদ্ধে মামলা নেয়া হবে বলে জানান। এ ছাড়া ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে নারীসহ ৫১ জনকে আটক করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
আশুলিয়া থানার ওসি আবু বকর সিদ্দিক জানান, আশুলিয়ায় আন্দোলনকারী শ্রমিক ও যৌথ বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা সেনাবাহিনী ও র্যাবের ৯টি গাড়ি ভাঙচুর করেছে। এ সময় শ্রমিকদের হামলায় শিল্প পুলিশের এসপি সারোয়ার আলম, র্যাবের এএসপি, সেনাবাহিনীর কর্নেল, লে. কর্নেল, মেজর, সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার ও ৪ জন সৈনিকসহ অন্তত ২০ জনসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। এ ছাড়া হামলায় জড়িত সন্দেহে ঘটনাস্থল থেকে ৩ নারীসহ ৫১ জনকে আটক করা হয়েছে। আটককৃত এবং হামলাকারীদের বিরুদ্ধে সরকারি কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে মামলা দায়ের করা হবে বলেও জানান তিনি।