প্রত্যয় স্কিম বাতিল, শিক্ষকদের সুপারগ্রেড দেওয়া ও স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রণয়নের দাবিতে প্রায় সাড়ে তিন মাস ধরে সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধন, অবস্থান কর্মসূচি, সর্বাত্মক কর্মবিরতিসহ নানা পদ্ধতিতে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন শিক্ষকরা। দাবি নিয়ে কঠোর অবস্থানে থাকলেও শিক্ষকদের এ আন্দোলনে এখনও কোনও অগ্রগতি দেখা যায়নি। আন্দোলনের বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কোনো বৈঠকও হয়নি তাদের।
সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয় স্কিম’ বাতিলের দাবিতে সোমবার (৮ জুলাই) অষ্টম দিনের মতো সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালন করেছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির মোর্চা বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের এ কর্মসূচিতে অচল হয়ে পড়েছে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগরসহ দেশের অন্তত ৩৫ পাবলিক বিশ্ববিদ্ক শিক্ষক নেতা জানিয়েছেন, তারা সরকারের সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা করছেন। তবে দীর্ঘ আন্দোলনের পরও সরকারের কোনো মহল তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের মূল ফটকে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যাপক আখতারুল ইসলাম বলেন, আমরা সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালন করছি, তবু রাষ্ট্র থেকে একটি ফোন কল পর্যন্ত করা হয়নি। এটি শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা।
এর আগে গত ৩ জুলাই ছাত্রলীগের এক সাবেক নেতার মাধ্যমে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন শিক্ষক সমিতির নেতারা।
এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি নিজামুল হক ভূঁইয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে শিক্ষক প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় বসার কথা জানান তিনি। ৪ জুলাই এ সভাটি হওয়ার কথা থাকলেও পরে স্থগিত হয়ে যায়।
তবে খুব শিগগিরই বৈঠক হবে বলে প্রত্যাশা করছেন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির মহাসচিব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক নিজামুল হক ভূঁইয়া। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, বৈঠকটি স্থগিত হয়েছে। এখনও কারও সঙ্গে আলোচনা হয়নি। তবে আমার সঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীসহ অনেকের সঙ্গে কথা হয়েছে। অচিরেই আমরা আলোচনা আশা করছি এবং তা হতে হবে।
তিনি জানান, সরকারের মধ্য থেকে একটি মহল শিক্ষকদের সরকারের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভুল বোঝাচ্ছে।
নিজামুল হক ভূঁইয়া বলেন, সরকারের মধ্য একটি দুষ্ট চক্র রয়েছে। যারা ২০১৫ সালে ষড়যন্ত্র করেছে। সরকারের ভেতর থেকে রাজতন্ত্র চালাচ্ছে। ২০২৪ সালে তারা একই কায়দায় শিক্ষকদের প্রত্যয় স্কিম চাপিয়ে দিয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যান
প্রত্যয় স্কিমের অনেকগুলো বিষয় নিয়ে শিক্ষকদের অস্পষ্টতার পরিপ্রেক্ষিতে গত ২ জুলাই প্রত্যয় স্কিমের প্রাসঙ্গিক বিষয়ে স্পষ্ট করে অর্থমন্ত্রণালয় থেকে একটি বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল। শিক্ষক সমিতির নেতারা এ বিজ্ঞপ্তি প্রত্যাখ্যান করেছেন। একইসঙ্গে দীর্ঘ আন্দোলন কেবল একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সমাধান করতে চাওয়াকে শিক্ষকদের প্রতি অবজ্ঞা হিসেবে দেখছেন তারা।
ঢাকা শিক্ষক সমিতির আরেক নেতা অধ্যাপক আব্দুর রহিম বলেন, যারা এ স্কিম করেছে তারা শিক্ষকদের রেগুলেট করতে চায়। তারা ভেবেছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যেভাবে তারা নিয়ন্ত্রণ করে, শিক্ষকদেরও সেভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে। ২ জুলাই তারা যে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে তাও এক ধরনের অবজ্ঞা।
তিনি বলেন, আমাদের সঙ্গে এখনও সরকারের কারও সঙ্গে আলোচনা হয়নি। এটা অবাক করার মতো। কারণ আটদিন ধরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অচল রয়েছে। আমরা অবস্থান কর্মসূচি পালন করছি। তবুও কারও টনক নড়ছে না।
এ বছরের ১ জুলাই থেকে যেসব যারা শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ পাবেন প্রত্যয় স্কিম তাদের ওপর কার্যকর করা হবে। শিক্ষকরা বলছেন, প্রত্যয় স্কিমে নানা সুবিধা উল্লেখ করে টাকার যে হিসেব দেখানো হয়েছে তাতে বড় ধরনের শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে।
শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যাপক ড. আখতারুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, সমকালীন বেতনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পেনশন নির্ধারিত হয়। কিন্তু তা না করে প্রত্যয় স্কিমে টাকার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। ওনারা যে হিসেব দিয়েছেন তা ২০২৪ সালের জন্য। কিন্তু যে পেনশন ব্যবস্থা প্রণয়ন করেছে তা ২০৫৪ সালের জন্য।
অর্থমন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নতুন এ পেনশন ব্যবস্থায় এককালীন নয় বরং মাসিক হিসেবে ১ লাখ ২৪ হাজার ৬৬০ টাকা করে আজীবন পেনশন পাবেন। শিক্ষকদের মাসিক কর্তনকৃত টাকা থেকে জমবে ১৮ লাখ টাকা। তিনি যদি ১৫ বছর ধরে পেনশন পান সেক্ষেত্রে তার মোট প্রাপ্তি হবে ২ কোটি ২৪ লাখ ৩৮ হাজার ৮০০ টাকা, যা তার জমার প্রায় ১২.৫ গুণ।
অধ্যাপক আখতারুল ইসলাম বলেন, এ হিসাব সম্পূর্ণ সমস্যাজনক। ১৯৯০ সালে শিক্ষকরা যে বেতন পেতেন আজ তার কয়েকগুণ বেশি পান। আমার এমন অনেক সহকর্মী আছেন যারা ৭০০ টাকায় চাকরি শুরু করেছেন। কিন্তু আজ শিক্ষকদের বেতন সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বেড়েছে। তাহলে ২০৫৪ সালে একজন শিক্ষকের বেতন কয়েকগুণ বাড়বে। একইসঙ্গে মূল্যস্ফীতির কারণে টাকার মান কমবে। পাশাপাশি জীবনযাত্রার মানও বাড়বে। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষকরা ২০৫৪ সালের পর ১ লাখ ২৪ হাজার টাকা থেকে বেশি বেতন পেতে পারেন। যারা এ স্কিম করেছে অঙ্ক জানে না বলেই তারা এমন অপরিপক্ব কাজ করেছে।