সর্বশেষ
Home » অন্যান্য » এত আয়োজন তবুও যানজট মুক্ত হচ্ছে না ঢাকা

এত আয়োজন তবুও যানজট মুক্ত হচ্ছে না ঢাকা

বিশৃঙ্খল ঢাকার সড়ক, গায়েব ই-টিকেটিংমাথার উপর দ্রুতগতির মেট্রোরেল। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। মোড়ে মোড়ে ফ্লাইওভার। তবুও যানজট মুক্ত হচ্ছে না ঢাকা। এর অন্যতম একটি কারণ সড়কে বিশৃঙ্খলা। শৃঙ্খলা ফেরাতে চালু হয়েছিল ‘নগর পরিবহন’ সেবা। তারও এখন মরণ দশা। বাসের ভাড়া নৈরাজ্য কমাতে চালু হয়েছিল ই-টিকেটিং পদ্ধতি। বছর ঘুরতেই গায়েব এই পদ্ধতি। সড়কে বাসের যাত্রী ওঠা-নামা করতে করা হয়েছিল বাস স্টপেজ, যাত্রী ছাউনি।সে সবের অধিকাংশই এখন পরিত্যক্ত। যা আছে, তাও ব্যবহার হচ্ছে না। সবমিলে ঢাকার সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর নানা চেষ্টা হলেও তা মুখ থুবড়ে পড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার সড়ক সুশৃঙ্খল করতে হলে ‘নো কস্ট, ভেরি ইফেক্টিভ’- এমন কাজগুলো সবার আগে করতে হবে। যে কাজগুলো হয়েছে তার রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। এরপর ধাপে ধাপে মধ্যম, উচ্চমানের বিনিয়োগ করতে হবে। সুশৃঙ্খলভাবে বিনিয়োগ করে পরিবহনের বিশৃঙ্খলা কমানোর জন্য সমন্বিত রূপরেখায় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে।
বাসের ই-টিকেটিং গায়েব!
বাসে ভাড়া নৈরাজ্য। যাত্রী-কন্ট্রাক্টরের বাকবিতণ্ডা। হেনস্তা। পাঁচ-দশ টাকার জন্য মারামারি। ঢাকার গণপরিবহনে এর সবকিছুই হয়। এসব কমিয়ে আনতে চালু হয়েছিল ই-টিকেটিং পদ্ধতি। তবে চালুর কয়েক মাস পরেই মুখ থুবড়ে পড়ে এটি। আর এখনতো বাস থেকে গায়েব হয়েছে ই-টিকেটিং পদ্ধতি। এতে ফের বেড়েছে ভাড়া নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা। ঢাকার বিভিন্ন রুটের ৫৯টি পরিবহন কোম্পানির ৩ হাজার ৩০৭টি বাসে ই-টিকেটিং চালু করা হয়েছিল। তখন নির্ধারিত ভাড়ায় যাতায়াত করতে পারায় স্বস্তি প্রকাশ করেছিল যাত্রীরা। তবে এখন ই-টিকেটিং না থাকায় আগের মতো ভাড়া বেশি নেয়ার অভিযোগ করছে যাত্রীরা।
কমলাপুর, মগবাজার, ফার্মগেট দিয়ে মিরপুর রুটে চলাচল করে আয়াত পরিবহনের বাস। আয়াত বাসের হেলপার রনি মিয়া বলেন, মেশিন নষ্ট হয়ে গেছে। এরপর থেকে হাতেই ভাড়া কাটি। মালিকরা নতুন মেশিন দেয়ও না। আমাদের না দিলে কেমনে কাটুম। পোস্তগোলা থেকে বাসাবো, বাড্ডা, কুঁড়িল দিয়ে উত্তরা রুটে চলাচল করে রাইদা পরিবহন। ই-টিকেটিং চালুর পর থেকে কয়েকমাস বাসটিতে মেশিনে ভাড়া কাটতে দেখা গিয়েছিল। তবে এখন তার হদিস নেই। রাইদা পরিবহনের হেলপার নয়ন হোসেন বলেন, মেশিনে ভাড়া কাটতে অনেক সময় লাগে। আর অফিস টাইমে এত ভিড় থাকে যে, বাসের ভেতর থেকে ভাড়া নেয়াও যায় না। বাস থামানোর পর নেমে সবাই ভাড়া দেয়। এভাবে তো মেশিনে ভাড়া কাটা সম্ভব না। শিকড় বাসে মিরপুর ১২ থেকে ফার্মগেট নেমেছিলেন শহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, বাসে ভাড়া কাটার কোনো মেশিন ছিল না। ভাড়া বেশি নিতেই তারা মেশিন ব্যবহার করে না। ফয়েজ আহমেদ নামের আরেক যাত্রী বলেন, মিরপুর-১০ থেকে ফার্মগেট ২০ টাকা ভাড়া নিয়েছে। তবে কোনো টিকিট দেয়নি। এখন কোনো বাসেই ই-টিকেট দেখি না।
নগর পরিবহনের ‘মরণ দশা’: গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে চালু হয়েছিল ঢাকা নগর পরিবহন। অথচ চালুর দুই বছরেই ‘মরণ দশা’ হয়েছে নগর পরিবহনের। এখন সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কোন কাজেই আসছে না বাস রুট রেশনালাইজেশন কার্যক্রমের আওতায় চলা নগর পরিবহনগুলো। বরং লোকাল বাসের মতোই সড়কে চলছে তা। আর বাসে সংকট বাড়তে থাকায় সেবাও পাচ্ছেন না যাত্রীরা। রাজধানীতে ২১, ২২ ও ২৬ এই ৩টি রুটে ঢাকা নগর পরিবহনের বাস চলাচল করছে। তবে বাসের সংকটের কারণে কাউন্টারের কর্মীরাও উষ্মা প্রকাশ করছেন। তারা বলছেন, পর্যাপ্ত বাস না থাকার কারণে যাত্রী সেবা দেয়া যাচ্ছে না। একটা বাস এক-দুই ঘণ্টা পর পর স্টপেজে আসে। এসে যাত্রীরা একই রুটের অন্য বাসে চলে যায়। তবে চাকরি হারানোর ভয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশ্যে এসব বলতেও চান না কাউন্টার কর্মীরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ২১ নম্বর রুটের শাহ্বাগ কাউন্টারের এক কর্মী বলেন, নির্বাচনের আগে অনেক দিন বন্ধ ছিল বাস। নির্বাচনের পর চালু হয়েছে। কিন্তু ১৪-১৫টা বাস দিয়ে দুই পাশে যাতায়াত করে। একেকটা বাস আসতে দুই ঘণ্টাও লেগে যায়। যাত্রীরা তো এত সময় অপেক্ষা করবে না। তারা অন্য বাসে চলে যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অন্য একটি কাউন্টারের কর্মী বলেন, আগে এক কাউন্টার থেকে ছয়-সাত হাজার টাকার টিকিট বিক্রি হতো। কিন্তু এখন দুই হাজার টাকাও হয় না। আগে বাস বেশি ছিল। যাত্রীও ছিল। এখন বাসের সঙ্গে যাত্রীও কমে গেছে। অনেকগুলো কাউন্টারও উঠে গেছে।
প্রথম চালু হওয়া ২১ নম্বর রুটের (ঘাটারচর থেকে মোহাম্মদপুর, ঝিগাতলা, শাহ্বাগ, মতিঝিল, যাত্রাবাড়ী, সাইনবোর্ড হয়ে কাঁচপুর) ৫০টি বাসের মধ্যে বিআরটিসি’র ৩০টি, ট্রান্স সিলভার ২০টি বাস পরিচালনার কথা ছিল। গত বছরের এপ্রিল ও মে মাসে দুই ধাপে ট্রান্স সিলভা তাদের সব বাস বন্ধ করে দেয়। তবে বর্তমানে ২১ নম্বর রুটে বিআরটিসি’র ৩০টা দ্বিতলবিশিষ্ট বাস চলছে বলে জানায় ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)। আর ঘাটারচর, ওয়াশপুর, বছিলা, মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড, আসাদগেট, ফার্মগেট, বাংলামোটর, শাহ্বাগ, কাকরাইল, মতিঝিল, টিকাটুলী, কাজলা, কোনাপাড়া এবং স্টাফ কোয়ার্টার পর্যন্ত ২২ নাম্বার রুট। ২০২২ সালের ১৩ই অক্টোবর চালু হয় ২২ নম্বর রুট। এই রুটে ১০০টি বাস চালানোর ঘোষণা থাকলেও বর্তমানে অভি মোটরসের ১০টি বাস চালানো হচ্ছে। আর ২৬ নম্বর রুটে ২৫টি বিআরটিসি’র দ্বিতল বিশিষ্ট বাস চলছে বলেও জানায় ডিটিসিএ।
এসব রুটের নগর পরিবহনের মরণ দশা হলেও নতুন করে আরও দু’টি রুটে ঢাকা নগর পরিবহন চালানোর প্রক্রিয়া চলছে বলে জানিয়েছে ডিটিসিএ। বাস রুট রেশনালাইজেশন প্রকল্প পরিচালক ধ্রুব আলম মানবজমিনকে বলেন, বর্তমানে ২১, ২২ আর ২৬ নম্বর রুটে নগর পরিবহনের বাস চলছে। ২২ নম্বর রুটে ৫০টি বাস চালানোর কথা। আমরা সেটা করে ফেলবো।
যেখানে ইচ্ছা থামে বাস, পরিত্যক্ত যাত্রী ছাউনি: বোদ্ধমন্দির সড়কে দাঁড়িয়েছিলেন তোফাজ্জল হোসেন। রামপুরা যাবেন। বাসগুলো মোড়ে থামিয়ে থামিয়ে যাত্রী তুলছে। তার কিছুটা দূরে যাত্রী ছাউনি। সেখান থেকে কেন বাসে উঠছেন না জানতে চাইলে তোফাজ্জল বলেন, সেখানে রামপুরার কোনো বাস ছাড়ে না। লাব্বাইক বাসের ওয়েবিল বসানো হয়েছে সেখানে। শুধু লাব্বাইকের যাত্রীরা ওখানে ওঠানামা করেন। তোফাজ্জলের মতোই অনেকেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে চলন্ত বাসে উঠছেন। কেউ কেউ ঝুলে ঝুলে যাচ্ছেন। অনাবিল, রাইদা, তুরাগ, নূরে মক্কাসহ বিভিন্ন বাস চলে এই রুটে। তবে কোনো বাসই স্টপেজ ব্যবহার করে না। কমলাপুর ওভারবিজ্রের পাশে একটি যাত্রী ছাউনি রয়েছে। নিচে বসার সিটগুলো পরিত্যক্ত পড়ে আছে। উপরের ছাউনিগুলো গায়েব। পাশেই মলমূত্র পড়ে আছে। মেহেদী হাসান নামের এক পথচারী বলেন, এগুলোর কোনো রক্ষণাবেক্ষণ হয় না। ছাউনি করছে কিন্তু তা চোররা বিক্রি করে খেয়ে ফেলছে। দেখার কেউ নাই। আমাদের রোদের মধ্যে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
মৎস্য ভবনে বাস স্টপেজে যে যাত্রী ছাউনি আছে সেখানে রজনীগন্ধা, মালঞ্চ ও বিকল্প বাসের ওয়েবিল বসে। ছাউনিতে সবসময় থাকেন ওয়েবিলের কর্মীরা। অন্যবাসগুলোও যেখানে খুশি সেখান থেকেই যাত্রী তোলেন। মালঞ্চ পরিবহনের ওয়েবিল কর্মী সোহেল বলেন, যাত্রীদের সব জায়গা থেকেই ওঠানো লাগে। শুধু বাস স্টপেজ থেকে উঠাতে গেলে অনেক যাত্রী পাওয়া যায় না। রমনার শিশু পার্কের সামনে যে যাত্রী ছাউনি রয়েছে সেখানে বসেছে হকার। একটা ছাতা ফুটিয়ে একটা কোম্পানির সিম বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া রমজান, মালঞ্চ ও তরঙ্গ বাসের ওয়েবিলও বসে সেখানে। ঢাকার অধিকাংশ যাত্রী ছাউনিগুলো এমন পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় হকার আর ওয়েবিলের কর্মীরা দখল করে আছে। স্টপেজগুলোতেও থামানো হয় না বাস। তাই ঢাকার এসব যাত্রী ছাউনিগুলো কাজে আসছে বলেও মনে করছে সংশ্লিষ্টরা।
সার্বিক বিষয়ে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, বিনিয়োগের কিছু বেনিফিট সব সময় পাওয়া যায়। কিন্তু সার্বিক বেনিফিট পাওয়ার জন্য সামগ্রিক সমন্বয়, পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। পরিকল্পনার আগের কাজগুলো সম্পন্ন না করে পরের ভারী পরিকল্পনা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এতে এই ধরনের বিশৃঙ্খলা রয়ে গেছে।
গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য গণপরিবহন সংশ্লিষ্ট কোনো লোক নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ঢাকার ভেতরেই হাতিরঝিলে সুশৃঙ্খল গণপরিবহন আছে। বাস স্টপেজে লাইনে দাঁড়িয়ে সেবা দেয়। পাল্টাপাল্টি হয় না, আঁচড় লাগে না, মান আছে। সেটা দেখেও শেখার আগ্রহও নেই। তিন মেয়াদে মেয়ররা যাচ্ছেন। সমস্যা সমাধানে যদি ধ্যান-জ্ঞান না থাকে তাহলে সেই ভুল পথে সমাধান করতে গিয়ে যে ৪-৫ বছর পার করে দেয়া হয় এরমাঝে সমস্যা আরও জটিল হয়ে যায়। মেয়রের কাজের যে স্মার্টনেস থাকার কথা ছিল সেটা নেই। তারা জোড়াতালি দিতে যান। এই ধরনের গণপরিবহনে বিশৃঙ্খলা রেখে ঢাকাকে স্মার্ট করা সম্ভব না।
তিনি বলেন, বাস রুট রেশনালাইজেশনে পুরনো বাস প্রতিস্থাপনের সুযোগ নেই। ব্যবসায়ের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। একটা রুটে একটা কোম্পানি সেবা দেবে, সেখানে যারা বিনিয়োগ করতে চায় করবে। হাতিরঝিলে সরকারকে লাভের ৫ শতাংশ দিচ্ছে। আর ঢাকার বাসের বদনাম আর যানজট ছাড়া সরকার কিছুই পাচ্ছে না। মেট্রোর মতো জটিল প্রজেক্ট করা হয়েছে। কিন্তু ছোট কাজগুলো না করলে বড় কাজের সফলতা পাওয়া যাবে না। ছোট ছোট গাড়িকে নিরুৎসাহিত করতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *