আচমকা বেড়ে গেছে বন্ধুরাষ্ট্র কানাডা সফরে আগ্রহী বাংলাদেশিদের সংখ্যা। ভ্রমণ, উন্নত পড়াশোনা, ব্যবসা-বাণিজ্য, ফ্যামিলি রি-ইউনিয়ন এবং স্কিল মাইগ্রেশন- সব মিলে ঢাকা থেকে কানাডার ভিসা আবেদনে এক ধরনের ‘অস্বাভাবিকতা’ তৈরি হয়েছে! ধরা পড়ছে অসাধু ট্র্যাভেল এজেন্সির জাল-জালিয়াতির ঘটনাও। ব্যয় সংকোচনে ঢাকা থেকে কানাডার ভিসা প্রসেসিং সেন্টার সরিয়ে নেয়া হয়েছে বহু আগেই। অবশ্য বিকল্প হিসেবে অনলাইনে ভিসার আবেদন গ্রহণ, কেন্দ্রীয় সরকারের পূর্বানুমতি বা প্রাথমিক অনুমোদন এবং চূড়ান্ত পর্বে ভিএফএস গ্লোবালের রিজিওনাল যেকোনো অফিসের মাধ্যমে পাসপোর্টে ভিসা স্টাম্পিংয়ের পথটি খোলা রয়েছে। গত ক’বছর ধরে এ প্রক্রিয়ায় ভিসা দিচ্ছে কানাডা। প্রক্রিয়াটি বেশ স্বাভাবিকই ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ভিসা আবেদনের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির ফলে সেই প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে অনুমোদন পরবর্তী ভিসা স্ট্যাম্পিংয়ের জন্য ভিএফএস-এ পাসপোর্ট সাবমিশনে শিডিউল না পাওয়ার অভিযোগ দিনে দিনে বাড়ছিল। এ নিয়ে ভিএফএস নিজেদের দায় এড়িয়ে চলছিল। তাদের তরফে বরাবরই মধ্যস্বত্বভোগী বা দালালের অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়েছে।
বাংলাদেশ থেকে ভিসা আবেদনের অস্বাভাবিকতা, জেনুইন আবেদনকারীদের হয়রানির অভিযোগসহ সামগ্রিক ব্যবস্থা খতিয়ে দেখতে অনেকটা নীরবেই ঢাকা ঘুরে গেছেন কানাডার উচ্চ পর্যায়ের কনস্যুলার টিম। যার নেতৃত্বে ছিলেন অভিবাসন, শরণার্থী এবং নাগরিকত্ব বিষয়ক এশিয়া অঞ্চলের ডিরেক্টর টাইলার অ্যারেল। এই অঞ্চলে আইআরসিসি’র নয়টি অফিসের তত্ত্বাবধায়ক তিনি। রিজিওনাল ওই সব অফিস থেকে অভিবাসন সংক্রান্ত সমস্যাগুলো সমাধানের পাশাপাশি কানাডার স্বল্প সময়ের জন্য যেতে ইচ্ছুক ভ্রমণকারী, শিক্ষার্থী ও স্কিল মাইগ্রেন্টস (যারা কর্মের সন্ধানে যাচ্ছেন) এবং স্থায়ীভাবে যেতে আগ্রহী ব্যক্তিদের ভিসা দিয়ে থাকে। ওয়াকিবহাল কূটনৈতিক সূত্র কনস্যুলার টিমের নিঃশব্দে ঢাকা সফরের বিষয়টি মানবজমিনকে নিশ্চিত করেছে।
জানিয়েছে, কনস্যুলার টিম খোলনলচে বিষয়গুলো খতিয়ে দেখার চেষ্টা করেছে। তারা বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্বশীলদের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক করেছেন। যার মধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও ছিল। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোন লেভেলে বৈঠক হয়েছে তা প্রকাশ না করা হলেও দায়িত্বশীল কূটনৈতিক সূত্র এটা নিশ্চিত করেছে যে, সেখানে জেনুইন ভিসা আবেদনকারীদের হয়রানি বন্ধ তথা তাদের ভিসা প্রক্রিয়ায় স্মুথ করার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। সরকারি একটি সূত্র জানায়, ঢাকায় কানাডার ভিসা প্রক্রিয়ার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ভিএফএস গ্লোবালের সঙ্গে বৈঠক করেছে কনস্যুলার টিম। তারা ভিএফএস’র চট্টগ্রাম এবং সিলেট অফিসে লোকবল বাড়ানো এবং সার্ভিস আরও দ্রুততর করার নির্দেশনা দিয়েছেন। সেই সঙ্গে যেকোনো অভিযোগ তাৎক্ষণিকভাবে আমলে নিতে প্রয়োজনে কানাডা সরকারের নজরে আনার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের অভিবাসনপ্রত্যাশীদের পছন্দের গন্তব্যের তালিকায় শীর্ষ অবস্থানে কানাডা। কারণ হিসেবে দেশটির সামাজিক সুরক্ষা ও জীবনযাত্রার মানকেই চিহ্নিত করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যমতে পরিবেশ, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা থেকে শুরু করে সামাজিক সুরক্ষা ও জীবনযাত্রার মানের দিক থেকে কানাডার শহরগুলো বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক উন্নত। আবার দেশটিতে আইনের নানা ফাঁকফোকর গলিয়ে অর্থ ও সম্পদ পাচার করে বিনিয়োগকারী কোটায় অভিবাসনের সুযোগও নিচ্ছেন অনেকে। এ ছাড়া কেউ কেউ আইনের নাগাল এড়াতে বা শরণার্থী হিসেবেও দেশটিতে যাচ্ছেন। কানাডা সরকার প্রকাশিত তথ্য (জনশুমারি) অনুযায়ী, দেশটিতে বর্তমানে বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা ৭০ হাজার ৯০ জন। এরমধ্যে ২০১১ থেকে ২০২১- এক দশকেই গেছেন এক তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ২৫ হাজার ৩৬০ জন। অভিবাসন বিশেষজ্ঞ সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. শহিদুল হক মনে করেন এশিয়া থেকে অভিবাসী গ্রহণে কানাডা অনেক উদার। দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে কানাডার কোটাও রয়েছে। শিক্ষার্থী ও অন্যান্য ভিসা প্রদানে গত এক দশক অনেক সহজ সময় ছিল। এ কারণে সংখ্যাটা এক দশকে খানিকটা বেড়েছে। কানাডায় যারা গেছেন, তারা ভিসা নিয়েই গেছেন এমন মন্তব্য করে মিস্টার হক বলেন, কানাডাতে অবৈধভাবে যাওয়ার পথ নেই বললেই চলে। অবশ্য আবাসন সংকট মোকাবিলায় অতি সম্প্রতি বিদেশি শিক্ষার্থী গ্রহণ কমিয়ে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে কানাডা সরকার।
গত ২২শে জানুয়ারি জাস্টিন ট্রুডোর সরকার জানায়, চলতি ২০২৪ সালে তারা আগের বছরের তুলনায় ৩৫ শতাংশ কম শিক্ষার্থীকে ভিসা দেবে। গত বছর প্রায় ৯ লাখ বিদেশি শিক্ষার্থীকে ভিসা দিয়েছে কানাডা। ট্রুডো সরকারের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে রিজিওনাল কনস্যুলার টিমের ঢাকা সফরের কোনো যোগসাজশ আছে কিনা? তা খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছেন পেশাদাররা। তাছাড়া ভারতের সঙ্গে কানাডার টানাপড়েনের প্রভাবে এ অঞ্চলের অন্য দেশগুলোতে কানাডা সক্রিয় কিনা? সেটিও বিবেচনায় রাখছেন কেউ কেউ।