সর্বশেষ
Home » অন্যান্য » সরকারের কাছে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের দেনা ৪০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে

সরকারের কাছে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের দেনা ৪০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে

সরকারের কাছে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের দেনা দিনে দিনে বাড়ছে। সরবরাহ করা বিদ্যুতের দাম নিয়মিত পরিশোধ না করায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি এমন প্রতিষ্ঠানের কাছে সরকারের দেনা ৪০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এমন অবস্থায় চলতি মওসুমের সামনের সময়ে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ ঠিক রাখতে ডলার সংস্থানের নিশ্চয়তা চাইছেন বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকরা। গতকাল সমন্বয় সভা থেকে তারা এই দাবি জানিয়েছেন। জ্বালানি আমদানিতে পর্যাপ্ত ডলার সংস্থান না হলে সামনে পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে- এমন আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন তারা।

দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পর্যাপ্ত সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও জ্বালানি সংকটের কারণে চাহিদা মোতাবেক বিদ্যুৎ সরবরাহ ঠিক রাখা যাচ্ছে না। ডলার সংকটের কারণে এই খাতের ভোগান্তি আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এ বিষয়ে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ইমরান করিম মানবজমিনকে বলেন, গতকাল আমাদের একটি সমন্বয় সভা হয়েছে। সেখানে ডলার সাপোর্টে সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জ্বালানি প্রয়োজন। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, ডলার সহযোগিতা পেলে বিদ্যুৎ সরবরাহ ঠিক রাখা সম্ভব হবে।

মে মাসে হয়তো বিদ্যুৎ সরবরাহ একটু ভালো হতে পারে। বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সরকারের কাছে ২০ হাজার কোটি টাকা পাওনা ছিল। বন্ডসহ অন্যান্য সুবিধা দেয়ায় এই দেনা এখনো ১১ হাজার কোটি টাকা হয়েছে। তাপপ্রবাহ থাকায় এখন সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে কেন্দ্রগুলো। নিয়মিত বিল পরিশোধ না হলে সামনে এই দেনা আরও বেড়ে যাবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানায়, বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে উৎপাদন সক্ষমতার কোনো ঘাটতি নেই। তবে ঘাটতি আছে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লা, এলএনজি ও জ্বালানি তেলের সরবরাহে। চাহিদামতো জ্বালানি না পাওয়ায় গেল দু’বছর গ্রীষ্ম মৌসুমে ব্যাপক লোডশেডিংয়ে ভুগতে হয়েছে গ্রাহককে। এবার গ্রীষ্ম মৌসুমে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ চাহিদা ধরা হয়েছে প্রায় ১৮ হাজার মেগাওয়াট।
দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি। এ দুই শক্তির ওপর ভিত্তি করেই নেয়া হয়েছে দেশের সব উন্নয়ন পরিকল্পনা। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাওনা ৩৭ হাজার ৬৪১ কোটি টাকা এবং গ্যাস বিক্রিতে পেট্রোবাংলার পাওনা তিন হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। এরমধ্যে বেসরকারি খাতের রেন্টাল ও আইপিপির পাওনা ১৫ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর পাওনা ছয় হাজার ৬৫৪ কোটি টাকা, ভারতের আদানি গ্রুপ পাবে ৪ হাজার কোটি টাকার উপরে, সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর পাওনা ৯ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা, ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি বাবদ দেনা এক হাজার ৯৪৮ কোটি টাকা ও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাওনা ৯ হাজার কোটি টাকা।

পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, শনিবার সাপ্তাহিক বন্ধের দিনে ১৫ হাজার ৩৮৪ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদার বিপরীতেও সরবরাহ ঠিক রাখা যায়নি। এতে ৮৯৮ মেগাওয়াট বিদ্যুতের লোডশেডিং করতে হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগ এ হিসাব দিলেও প্রকৃত লোডশেডিং আরও বেশি বলে খাত বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
এদিকে, গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিদ্যুতের চাহিদা। ফলে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ঘাটতি থাকায় চলছে বিদ্যুতের লোডশেডিং। ঢাকায় লোডশেডিং কম হলেও গ্রামগঞ্জে লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ মানুষ। ১৬ হাজার ২৩৩ মেগাওয়াট রেকর্ড বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিনও (২২শে এপ্রিল) সারা দেশে বিশেষত গ্রামাঞ্চলে গড়ে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা লোডশেডিং হয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, জ্বালানির অভাবে বা আমদানি করতে না পারায় গত দুই বছর গরমের সময় লোডশেডিং বেড়েছিল। শহরে দুই থেকে তিন ঘণ্টার লোডশেডিং হলেও গ্রামে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টার বেশি লোডশেডিংয়ের অভিযোগ ছিল গ্রাহকদের। এবারো তেমন পরিস্থিতি হওয়ার আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, রাজধানী ঢাকা ও বিভাগীয় শহরগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে দেশের গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুৎ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য অনুযায়ী, কোনো কোনো গ্রামীণ এলাকায় দৈনিক ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং করতে হচ্ছে।
পাওয়ার সেলের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ৩০ হাজার ২৭৭ মেগাওয়াট। গ্রাহক ৪ কোটি ৬৮ লাখ। তবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত জ্বালানির সংকট ও সঞ্চালন লাইন প্রস্তুত না থাকায় চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না।

এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে দেশের অর্থনীতির বিকাশ ও উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হতে পারে বলে আশংকা করছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। অপরদিকে চলমান এ সংকট শিগগিরই কাটিয়ে উঠবে বলে আশাবাদী বিদ্যুৎ খাতের সরকার সংশ্লিষ্ট শীর্ষ কর্মকর্তারা।
কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর জ্বালানি উপদেষ্টা, দেশের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে যে সংকট চলছে, তা একদিনে তৈরি হয়নি। দিনে দিনে এই সংকটকে পুঞ্জীভূত করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা চারটা কারণে এই অবস্থা ডেকে এনেছি। একটা হচ্ছে স্পিডি অ্যাক্ট। দ্রুত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ আইন তৈরি এই খাতে বিনিয়োগ প্রতিযোগিতাহীন করে লুণ্ঠনমূলক ব্যয় বাড়িয়েছে। মুনাফা অর্জনকারীদের সুযোগ বাড়িয়েছে। এই খাতে ব্যাপক ঘাটতি তৈরি করেছে। এটা অন্যায়, অযৌক্তিক ও শুধু বিনিয়োগকারী ও তাদের নেপথ্যে দৃশ্য-অদৃশ্যে থাকা কমিশনভোগীরা এতে লাভবান হয়েছে। এই আইন বন্ধ করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে বাঁচাতে হবে।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে চলমান সংকটের বিষয়ে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, প্রতিদিনই দেশে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে চলেছে। তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন বিদ্যুতের চাহিদা বেশি। এ চাহিদার কথা চিন্তা করেই আমরা জনগণকে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়িয়েছি। কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদনে যেসব উপাদান প্রয়োজন যেমন গ্যাস, ফার্নেস অয়েল ও কয়লা, এগুলোর জোগানে ঘাটতি রয়েছে। তিনি আরও বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি জোগান দিতে যেমন সমস্যা হচ্ছে পাশাপাশি অর্থনৈতিক সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের বকেয়া পরিশোধ করতেও সমস্যা হচ্ছে। তবে এ সমস্যা কাটিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সর্বাত্মক চেষ্টা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *