সর্বশেষ
Home » অপরাধ » পাহাড়সম দুর্নীতি: এদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় না আনলে জাতির মেরুদন্ড বিকলাঙ্গ হয়ে যাবে

পাহাড়সম দুর্নীতি: এদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় না আনলে জাতির মেরুদন্ড বিকলাঙ্গ হয়ে যাবে

কি হচ্ছে দেশে? কোথায় যাচ্ছে দেশ? এ যেন রক্ষক হয়ে ভক্ষকের কাজ! দুর্নীতি করে দেশের অর্থনীতিকে ফুটো করে দেয়া হচ্ছে। সম্প্রতি বিভিন্ন জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়া সাবেক সেনাপ্রধান, সাবেক আইজিপি, সাবেক ডিএমপি কমিশনার, এনবিআরের সদস্য ও এনবিআরের প্রথম সচিবসহ অনেকের দুর্নীতির মাত্রা ও তাদের এবং তাদের স্বজনদের নামে সম্পদের পরিমান দেখে জাতি স্তম্ভিত। তবে এগুলো Tip of the Iceberg! গোটা দেশের দুর্নীতির অল্প বা কিয়দংশ বের হচ্ছে। ভাল করে অনুসন্ধান করলে আরো অনেক লোমহর্ষক তথ্য বর্তমানে কর্মরত ও সাবেক সরকারি কর্মকর্তাদের আমলনামায় পাওয়া যাবে। এভাবেই চলতে থাকবে দেশ? এই দুর্নীতিবাজদের জন্যই কি লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন হয়েছিল দেশ? ভাবছি, বঙ্গবন্ধু আজ জীবিত বা ক্ষমতায় থাকলে, এই দুর্নীতিবাজদের পাহাড়সম দুর্নীতি ও পুকুর চুরির ধরণ দেখে কি করতেন বা কি ব্যবস্থা নিতেন!

সরকারকে সাধুবাদ জানাতে হয়, কেননা বর্তমান পারিপার্শ্বিক অবস্থায় সরকারের সদিচ্ছা ছাড়া এত বড় দুর্নীতির খবরাখবর গণমাধ্যমে আসতো না। আর আসলেও গণমাধ্যমের পক্ষে সেগুলো ছাপানো সম্ভব হতো না। তবে সরকারকে দুর্নীতিবাজদের ব্যাপারে আরও শক্ত ও নির্মম (ruthless) হতে হবে। দুর্নীতি করে যারা সম্পদের পাহাড় গড়েছে তাদের জমানো অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করাসহ তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে রাঘব বোয়ালদের দুর্নীতির খবর গণমাধ্যমে আসার আগে বা আসার সাথে সাথে তারা গা ঢাকা দিয়ে দেশের বাহিরে চলে গিয়ে অনেকটা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। এমনটি হবে কেন?

ঘুষ ও দুর্নীতি বাংলাদেশে যে কি পরিমান বেড়েছে তা চিন্তার বাইরে।

এগুলোর বিস্তৃতি ও ব্যাপকতা শুধুমাত্র ভুক্তভোগীরাই হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেন। সরকারি অফিসে অনেকটা ঘুষ ছাড়া টেবিলের ফাইল নড়ে না। কাস্টমার সার্ভিসের রেওয়াজ বা মানসিকতা ডেভেলপ করেনি পাবলিক অফিসে। সাদা পোষাকে সাধারণ মানুষের বেশে গোয়েন্দা সংস্থার লোক রাজউক, ভূমি অফিস, ইউনিয়ন অফিস, তহশীল অফিস, পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনসহ সরকারি অফিস সমুহে একটু ঘুরে আসলে বুঝতে পারবেন দেশে দুর্নীতির মাত্রা কতটুকু। এক সময় স্কুলে পড়ানো হতো ভাত বাংলাদেশের জাতীয় খাদ্য। এখন বোধ হয় সেটি আর নেই! এখন ঘুষকে জাতীয় খাদ্য বললে সম্ভবত: অত্যুক্তি হবে না। নৈতিকভাবে জাতি যে কত অধঃপতনের দিকে যাচ্ছে তা কি রাষ্ট্র নিয়ে যারা চিন্তা করেন তারা হৃদয়ঙ্গম করেন? সামান্য মিটার রিডার, অফিসের পিয়ন, এসআই ও মন্ত্রীর এপিএস – এই লেভেলের লোকও আজ কোটি কোটি টাকার মালিক! কোনো অঙ্কে বা যুক্তিতে মিলে না তাদের অসম আয় ও সম্পদের মাত্রা।
বড় বড় দুর্নীতিবাজরা চাকুরিতে থাকতে চটকদার কথা বলে, উপযাচক হয়ে মানুষকে জ্ঞান দেয়ার চেষ্টা করে, বুলি আওড়ায় দেশপ্রেমের। দেশপ্রেমের সংজ্ঞা তাহলে কি? কাদেরকে দেশপ্রেমিক বলবেন? যারা ঘুষ খায়, পাহাড়সম দুর্নীতি করে এবং জনগণের হক ও অর্থ মেরে সম্পদের পাহাড় গড়ে তাদেরকে কোন সংজ্ঞায় দেশপ্রেমিক বলবেন? তারাতো বরং গণবিরোধী ও দেশদ্রোহী। আর এই দেশদ্রোহীরাই দেশপ্রেমের বড় বড় বুলি আওড়ায়! চাকুরি জীবনে বড় বড় বুলি আওডায় আর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে শুদ্ধাচার সার্টিফিকেট ও দুদক থেকে একাধিকবার “দায়মুক্তি” সনদ নেয় কিন্তু অবসরে যাবার পর থলের বিড়াল বেরিয়ে আসতে থাকে।

দুর্নীতির নানা ধরণ ও প্রকার আছে। সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে অভাবনীয় দুর্নীতি হয়। বাংলাদেশের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী কোনো প্রকল্পই মূল বাজেট ও সময় অনুযায়ী শেষ হয় না। যেমন ৬০০ কোটি টাকার হাতিরঝিলের কাজ ২৫০০ কোটি টাকায়ও শেষ হয়নি। ৮ হাজার কোটি টাকার পদ্মা সেতুর বাজেট হয়েছে প্রথমে ২৮ হাজার কোটি টাকা। আরও প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়েও পরিকল্পনা মতো শেষ করা যায়নি। ৩৫০ কোটি টাকার ফ্লাইওভারের কাজ শেষ হয়েছে প্রায় ১৩০০ কোটি টাকায়। আরও অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যায় এভাবে। এই যে বাজেট ও খরচ বাড়ানো হয় এর বড় অংশ যায় দুর্নীতিবাজদের পকেটে।

সার্ভিস ও প্রকল্পের পাশাপাশি রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন আশংকাজনক হারে বেড়ে গেছে। রাজনৈতিক দলের পদ-পদবি বাগিয়ে নেয়া হয় টাকার বিনিময়ে। নির্বাচন যখন আসে শুরু হয় টাকার খেলা। চিন্তা করুন এক একজন সংসদ নির্বাচন ও উপজেলা নির্বাচনে কোটি কোটি টাকা খরচ করে! এমনকি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনের জন্যও অর্ধকোটি টাকার উপর খরচ করে। এই যে কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করা হয় নির্বাচনী বৈতরণি পার হতে, পাশ করার পর তো তার ঐ টাকা তোলার প্রশ্ন ও ধান্ধা আসে। এভাবেই দুর্নীতি চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ে। সাধারণ জনগণেরও নৈতিক অধঃপতন এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে যে সম্প্রতি বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দেখে আসলাম সব প্রার্থীর কাছ থেকে তারা টাকা খাওয়ার চেষ্টা করে! নির্বাচনে সৎ ও যোগ্য প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করা যে তাদের নৈতিক দ্বায়িত্ব ও সিভিক ডিউটি সেই বোধশক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলছে।

নিজের কথাই বলি- বৃটেনে নির্বাচন করলাম। পুরো বিলেতে ২০১৮ সালে বিজয়ী হওয়া বৃটিশ-বাংলাদেশি অরিজিন সব প্রার্থীদের চেয়ে রেকর্ড সংখ্যক ভোট বেশী পেয়ে লন্ডনের এক বার কাউন্সিলের কাউন্সিলর নির্বাচিত হলাম। নির্বাচিত হওয়ার পর টানা তিন বারের ডেপুটি স্পীকার। কই পকেট থেকে তো ৫০টি পাউন্ডও খরচ করতে হয়নি। অথচ হাজার হাজার পাউন্ড খরচ করার সামর্থ্য মহান আল্লাহপাক দিয়েছিলেন। বাংলাদেশে এই ধরনের স্বচ্ছ ব্যবস্থা হবে কখনও? জীবদ্দশায় কখনও আমরা দেখে যেতে পারব? রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন ও দুর্নীতি তো এভাবেই শুরু হয়। নির্বাচনে পকেট থেকে টাকা খরচ করলেইতো খরচের চেয়ে কয়েক গুন বেশী তোলার প্রশ্ন বা লোভ আসে।

আমাদের সমসাময়িক কালে স্বাধীনতা লাভ করা কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত উন্নয়নের কত উচ্চশিখরে পৌছে গেছে। আর আমাদের অনেক উন্নয়ন হলেও সেই মাত্রায় এগুতে পারছি না পাহাড়সম দুর্নীতির কারণে। অনেকে বলতে পারেন কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের কারণে এমন উন্নতির শীর্ষ শিখরে পৌঁছতে পেরেছে। কথাটা আংশিক সত্য। বাংলাদেশে হয়ত খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস সেই দেশ দুটির মতো নেই। তবে বাংলাদেশে স্রষ্টা প্রদত্ত (God gifted) অনেক কিছু আছে যা ঐ দেশ দুটিতে নেই। আর দেশের জনগণের উন্নত নৈতিক মান, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ও আইনের শাসন পুরোপুরি বিদ্যমান না থাকলে শুধু প্রাকৃতিক সম্পদ হলেই দেশ উন্নতির শীর্ষ শিখরে পৌঁছতে পারবে না। বরং তাতে দুর্নীতির মাত্রা আরও বাড়বে ও বিদেশে টাকা আরও বেশি পাচার হবে। চিন্তা করতে পারেন – বাংলাদেশের মতো একটি দেশ থেকে বছরে লক্ষ কোটি টাকার উপর পাচার হয়ে যায়! এমন দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজ ও দেশ হলে তাতে দেশের ভূগর্ভে খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের পরিবর্তে সোনার খনিও আবিষ্কৃত হলে প্রত্যাশিত ও লাগসই উন্নয়ন হবে না। বরং দুর্নীতি ও টাকা পাচারের হার জ্যামিতিক হারে বেড়ে যাবে।

আওয়ামীলীগ ও বিএনপি নি:সন্দেহে বাংলাদেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দল। দেশ ও দেশের বাইরে তাদের আছে অসংখ্য কর্মী ও সমর্থক। কিন্তু বিশাল এই কর্মী বাহিনীকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে, জাতি গঠনে ইস্পাত কঠিন প্রতিজ্ঞা করতে, মৌলিক মানবিক/নাগরিক গুণাবলি অর্জন করতে এবং সর্বোপরি তাদের ত্যাগ স্বীকারের মানসিকতা (sacrificing mentality) তৈরি করতে কোন ধারাবাহিক প্রশিক্ষণ চোখে পড়ে না। মনে রাখা দরকার দলে ভিড়লেই কোন লোক স্বয়ংক্রিয়ভাবে সৎ, দেশপ্রেমিক ও সুনাগরিক হয়ে যায় না। এজন্য দরকার চলমান (continuous ) প্রশিক্ষণ। অনেক ধান্ধায় লোকজন দলে ভিড়তে পারে। তাই যথাযথ ও ধারাবাহিক প্রশিক্ষণ ছাড়া বিশাল কর্মী বাহিনী ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে বা ক্ষমতার পালাবদলে হয়ে উঠতে পারে মারমুখী টাইপের, আখের গুছানোওয়ালা ও খাই খাই স্বভাবের। মনে রাখা দরকার সৎ, যোগ্য ও দেশপ্রেমিক কর্মীবাহিনী আকাশ থেকে নাজিল হবে না, মাটির নীচ থেকেও উঠে আসবে না। পরিকল্পিত ও ধারাবাহিক ইন্টেনসিভ প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই সৎ, যোগ্য ও দেশপ্রেমিক কর্মীবাহিনী গঠন করতে হবে। শংশ্লিষ্টরা সিরিয়াসলি ভেবে দেখতে পারেন। জাতি তাতে দারুণ উপকৃত হবে, সাথে আপনাদের সংশ্লিষ্ট দলও।

দুর্নীতি সমাজের ক্যান্সার। ক্যান্সার যেমন স্টেজ ফোর-এ গেলে রোগীকে আর বাঁচিয়ে রাখা যায় না। ঠিক তেমনি দুর্নীতির মাত্রা যেভাবে বাড়ছে এভাবে চলতে থাকলে জাতির অর্থনীতির মেরুদন্ড বিকলাঙ্গ হয়ে যাবে। তাই দেরি হবার আগে এখনই উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। দুর্নীতি দমনে সরকারের দায় বেশী হলেও সরকারের একার পক্ষে দুর্নীতি পুরোপুরি দমন করা সম্ভব নয়। এজন্য দরকার সমন্বিত উদ্যোগ। জনগণের নৈতিক চরিত্রের মান উন্নত করার জন্য দরকার সরকারী উদ্যোগ ও সামাজিক আন্দোলন। শতকরা একশত ভাগ দুর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া অসম্ভব। তাই রাঘব বোয়ালদের ধরে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করে সবার কাছে শক্ত বার্তা পাঠালে এটি প্রতিরোধ (Deterrent) হিসেবে কাজ করবে।

উচ্চপদস্থ আমলা ও বাহিনী প্রধানদের পাহাড়সম দুর্নীতির কারনে বহির্বিশ্বে আমাদের সুনাম ও ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে। গ্লোবাল ভিলেজে আধুনিক প্রযুক্তির যুগে ত্বরিতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে তাদের পাহাড়সম দুর্নীতির খবর। এতে জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। দুর্নীতি করে পার পেয়ে গেলে পুরো কর্মশক্তি (workforce) ও গোটা বাহিনী হতাশ ও মনোবলহীন (demoralised) হয়ে যাবে। এভাবে চলতে থাকলে আফ্রিকার চরম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর সাথে আমার দেশের নাম আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উচ্চারিত হবে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে প্রাপ্ত স্বাধীন বাংলাদেশের এমন পরিণতি কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়। তাই দুর্নীতিবাজ রাঘব বোয়ালদের খুঁজে খুঁজে বের করে এখনই লাগাম টেনে ধরুন ও তাদের পালিয়ে যেতে না দিয়ে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করুন।

নাজির আহমদ: বিশিষ্ট আইনজীবী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, রাষ্ট্রচিন্তক এবং ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *