রাজনীতিবিদরা কোটি টাকা লগ্নি কইরা ধান্দা করতে আসে। কিন্তু প্রজাতন্ত্রের বেতনভুক্ত কর্মচারী হিসেবে তাদের কাজ ছিল সম্পদ পাহারা দেয়া। একজন ব্যবসায়ী, অন্যজন বেতনভুক্ত কর্মচারী। তাহলে দায় বেশি কার? আমি মনে করি দেশটাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়ার পেছনে কর্মচারীদের দায়ই সবচে বেশি। যদ্দিন এই ঘুষখোরের দলকে নিয়ন্ত্রণে আনা না যাবে, তদ্দিন এই দেশের কোনো আশা-ভরসা নাই। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, ছোট সাইজের ঘুষখোরের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করতে হলে ঊর্ধ্বতন ঘুষখোরের পারমিশন নিতে হবে- যেদিন এই আইন পাস হইছে, সেদিন থেকেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
গত কিছুদিন ধরে নিউজ মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সরগরম হয়ে আছে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের ব্যাপক দুর্নীতির খবরাখবর নিয়ে। কোন কর্মচারী কতো শত কোটি লোপাট করেছে, প্রায়দিনই একের পর এক বেরিয়ে আসছে সেসব সংবাদ। কথা হলো তাদের এইসব অপকর্মের খবর আগে প্রকাশিত হলো না কেন? যে পরিমাণ চুরিদারির খবর পত্রপত্রিকা বা টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হচ্ছে তা তো আর এক-দুমাস বা বছরে করা হয়নি। লম্বা সময় তো লাগছেই। দেশের গোয়েন্দা সংস্থা এমন কী নিউজ মিডিয়াও কেন এতদিন জানলো না? নাকি জেনেও চুপ করেছিল? অনেক ক্ষেত্রেই কেন কর্মচারীটি অবসরে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলো? বিষয়টি খুবই রহস্যজনক!
ঘুষখোর ও দুর্নীতিবাজ হিসাবে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশের পরও কেন ওই ঘুষখোর পদার্থটিকে শুধুমাত্র বদলি করা হয় কিংবা ওএসডি করা হয়? কেন সঙ্গে সঙ্গেই তাকে চাকরি থেকে বের করে তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে না? কেন চাকরিতে বহাল রেখে ভবিষ্যতে আরও ঘুষ খাওয়ার সুযোগ দেয়া হচ্ছে?
রাষ্ট্রের কর্মচারীদের গতিবিধি সাধারণত রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারিতে থাকে।
উচ্চপদস্থ হলে তো আরও বেশি নজরদারি থাকে। এতকিছুর মধ্যেও পদার্থটি কীভাবে এত বিশাল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ জড়ো করলো, সেটা একটা বিরাট প্রশ্ন। এইদেশে ঘুষের কারবার একটি ‘পাস্ট পারফেক্ট কন্টিনিউয়াস টেনস্’-এ পরিণত হয়েছে। সাধারণ জনগণ সচেতন ও প্রতিবাদী না হলে, এটি অতীতে থেকে বর্তমান হয়ে ভবিষৎতেও বহাল তবিয়তে চলমান থাকবে বলে ধারণা করা যায়।
পঁচাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশে ‘সিভিল সার্ভেন্ট’ বা রাষ্ট্রের কর্মচারীরা নিজেদেরকে ‘সরকারি কর্মচারী’ বলে পরিচয় দিতে শুরু করলো। কারণ এই পরিচয়ের মধ্যে একটা বিরাট ধান্দা আছে। কথা ছিল তারা হবে সিভিল সার্ভেন্ট বা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। তারা প্রজাতন্ত্রের স্বার্থ মানে জনগণের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করবে। কিন্তু সিভিল সার্ভেন্ট হলে তো আর নিজের স্বার্থ রক্ষা করা যায় না। কাজেই তারা সরকারি কর্মচারী নামধারণ করলো। আর সরকারের চাটুকার হিসেবে নিজেদেরকে প্রমাণের মাধ্যমে তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। এভাবেই বিগত তিন-চার দশকে সিভিল সার্ভেন্টগুলো, যখন যে সরকার ক্ষমতায় থেকেছে তখন সেই সরকারের, চাটুকার হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে। ফলে, জনগণের ট্যাক্সের টাকায় জীবনধারণ করে ও জনগণের মঙ্গলচিন্তা করে কাজ করার তাদের ‘টাইমনাই’।
আমার অভিজ্ঞতা বলছে, রাষ্ট্রযন্ত্রে কর্মরত সিভিল সার্ভেন্টদের একটি বড় অংশ ঘুষখোর-দুর্নীতিবাজ। ধরা পড়ার আগ পর্যন্ত সবাই খুব সাধু। পরহেজগার একটা ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। বছর বছর হাজিরা দিতে মক্কা-মদিনা যায়। ধরাপড়ার পর দেখা যাচ্ছে বিরাট ঘুষখোর। জনগণের টাকায় বউ-পোলাপান নিয়ে খেয়েপরে বেঁচে থাকা চাকর-বাকদের হাতে দেশের সাধারণ মানুষ জিম্মি হয়ে পড়েছে। এভাবে একটা দেশ, একটা সমাজ চলতে পারে না।
কেউ কেউ বলেন, এই যে দুর্নীতির মহাসম্মেলন চলছে, এর জন্য রাজনীতিবিদরা দায়ী। আমিও বলি রাজনীতিবিদরা দায়ী। কিন্তু কতো পার্সেন্ট দায়ী তারা? আমার মতে, দুর্নীতির মহাউৎসবটা মূলত, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী ও রাজনীতিবিদ দ্বারা অভিনীত একটি যৌথ প্রযোজনার বাংলা ছায়াছবি। বাংলা সিনেমার মতোই আজগুবি আর উদ্ভট কাহিনীতে ভরপুর। এই ছবি দেখে দর্শক সহজেই বোঝে কে কালপ্রিট। শুধু অভিনেতারা বুঝতে পারে না, ঘটনা ক্যামনে ঘটলো। পুরা কাহিনীতে পুলিশ শেষ দৃশ্যে এসে বলবে- খবরদার! আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। একই কাহিনী যুগ যুগ ধরে চলছে, কোনো পরিবর্তন নাই।
যেকোনো ঘুষখোরের দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হওয়ার পর, প্রথমে দেশের বাইরে সমস্ত ক্যাশ ট্রান্সফার করে। এরপর এক সময় নির্বিঘ্নে দেশ ছড়ে চলে যায় ।
তারও অনেক পরে, ঘুষখোরটির দেশের বাইরে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা, সম্পদ বাজেয়াপ্ত এবং ব্যাংক হিসাব জব্দ করার নির্দেশ আসে? ছবিসহ খবর প্রচারের পরও কীভাবে ঘুষখোরটি এয়ারপোর্ট দিয়ে আপসে চলে যায়? ক্যামনে? এর সহজ উত্তর হলো, এয়ারপোর্টসহ বিভিন্ন বর্ডারে কর্মরত ঘুষখোররা তাকে পালিয়ে যেতে সরাসরি সহযোগিতা করেছে। দুষ্টু লোকেরা বলে, উপরের নির্দেশে তাদেরকে পালিয়ে যেতে দেয়া হয়। এই পয়েন্টাই সবচে জটিল। ঘুষখোরগুলো সবসময়ই এই ক্যামোফ্ল্যাক্সটা তৈরি করে পার পেয়ে যাচ্ছে। আসল ঘটনা হলো, পালাতে সাহায্য করেছে ঘুষখোরটির জাতি ভাই আরেকটি ঘুষখোর। কিন্তু প্রচার করে রাজনীতিবিদদের নাম। পুরোটাই একটা ভগিজগি। এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি, কাস্টমস, গোয়েন্দ সংস্থা, এখানে কী কোনো রাজনীতিবিদ চাকরি করে?
তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, রাজনীতিবিদের নির্দেশই ছিল। কিন্তু তোমাকে তো ট্রেনিং দিয়ে, সাংবিধানিক ক্ষমতা দিয়ে, অস্ত্র দিয়ে, বডিগার্ড দিয়ে, বেতন-ভাতা দিয়ে- চাকরিতে বসানো হইছিল পাহারাদার হিসাবে। কথা তো ছিল, যতই ফোন আসুক, যতই হুমকি-ধামকি দিক, তুমি মামা আইনের মধ্যে থাকবা। মাগার তুমি কি করলা? আগেই দুই নম্বরী ফাইল রেডি কইরা রাজনীতিবিদের ফোনের অপেক্ষায় বইসা রইলা।
রাজনীতিবিদরা কোটি টাকা লগ্নি কইরা ধান্দা করতে আসে। কিন্তু প্রজাতন্ত্রের বেতনভুক্ত কর্মচারী হিসেবে তাদের কাজ ছিল সম্পদ পাহারা দেয়া। একজন ব্যবসায়ী, অন্যজন বেতনভুক্ত কর্মচারী। তাহলে দায় বেশি কার? আমি মনে করি দেশটাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়ার পেছনে কর্মচারীদের দায়ই সবচে বেশি। যদ্দিন এই ঘুষখোরের দলকে নিয়ন্ত্রণে আনা না যাবে, তদ্দিন এই দেশের কোনো আশা-ভরসা নাই। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, ছোট সাইজের ঘুষখোরের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করতে হলে ঊর্ধ্বতন ঘুষখোরের পারমিশন নিতে হবে- যেদিন এই আইন পাস হইছে, সেদিন থেকেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
আমি বিশ্বাস করি, ঘুষখোরদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলেই দেশটাকে বাঁচানো যাবে। আর এজন্য, সবার আগে সঠিক ও সময়োপযোগী আইন পাস করতে হবে। তা না হলে, যতই তালা-চাবি লাগানো হোক, শূন্য খাঁচা পড়ে থাকবে। ঘুষখোর-দুর্নীতিবাজ পাখিরা চামে উড়ে চলে যাবে অজানায়। সময় থাকতে মনা হুঁশিয়ার!