গ্রামীণ টেলিকমের কর্মীদের লভ্যাংশের ২৫ কোটি ২২ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটির অন্য মামলাগুলো যেখানে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে সেখানে এই মামলাটির কার্যক্রম চলে অনেকটা বিদ্যুৎগতিতে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে তার বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে দুদক। শুরু হয়ে যায় বিচারকার্যও। কিন্তু হঠাৎ গত ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর পাল্টে যায় দৃশ্যপট। ৮ই আগস্ট প্রফেসর ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ১১ই আগস্ট প্রফেসর ইউনূসের বিরুদ্ধে করা দুদকের মামলা প্রত্যাহার করা হয়। ৫ই আগস্টের আগে আওয়ামী লীগ সরকার ও গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতায় দুদকে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে আরও চারটি মামলা করার প্রস্তুতি চলছিল। এসব মামলায় প্রফেসর ইউনূসের পরিবারের সদস্যদের জড়ানোর পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু প্রেক্ষাপট বদলে যাওয়ায় ওইসব মামলার ভবিষ্যৎ শেষ হয়ে যায়।
দুদক সূত্র জানায়, ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে দায়ের করা আগের মামলাটিও আওয়ামী লীগ সরকারের প্রেসক্রিপশনে করেছিল দুদক।
মূলত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত ইচ্ছা থেকেই মামলা করা হয় তার বিরুদ্ধে। এমনকি অতিদ্রুত অভিযোগপত্র দাখিলের নির্দেশও দেয়া হতো বলে জানা গেছে।
সূত্র আরও দাবি করেছে, একটি মামলা দিয়ে ইউনূসকে আটকানো যাচ্ছিল না বলে আরও চারটি মামলার প্রস্তুতি নেয়া হয়। যেখানে ড. ইউনূসের পরিবারের সদস্যদের আসামি করার পরিকল্পনা করা হয়। আর এই কাজে সক্রিয় ছিলেন দুদকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ ও তার দুই কমিশনার।
দুদকের এক কর্মকর্তা মানবজমিনকে নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, চলতি বছরের জুন মাসে গ্রামীণ ব্যাংকের অনিয়মের চিত্র তুলে ধরে একটি অভিযোগ জমা পড়ে দুদকে। সেই অভিযোগটি যাচাই-বাছাই শেষে খুব দ্রুত অনুসন্ধানের জন্য আমলে নেয় কমিশন। ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে যে অনুসন্ধান দলটি আগের মামলার কাজ করেছিল সেই দলকেই অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয়া হয়।
তিনি আরও বলেন, একটি অভিযোগের আদলে একাধিক মামলার ছক করা হয়েছিল যেখানে ড. ইউনূসের পুরো পরিবারের সদস্যদের আসামি করার পরিকল্পনা করা হয়। গত ২৬শে জুন গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নূর মোহাম্মদ দুদকের প্রধান কার্যালয়ে একটি লিখিত অভিযোগ দেন। অভিযোগটি দায়েরের প্রথম সপ্তাহেই অনুসন্ধানের জন্য অনুমোদন দেয় দুদক। সংস্থাটির এক কর্মকর্তা বলেন, আসলে অভিযোগটি গ্রামীণ ব্যাংকের পক্ষ থেকে করা হলেও মূলত তার নেপথ্যে কাজ করে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। শেখ হাসিনার নির্দেশেই এ অভিযোগ তৃতীয়পক্ষকে দিয়ে করানো হয়।
দুদকের ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, গোয়েন্দা সংস্থার ৭ থেকে ৮ জন কর্মকর্তা প্রতিদিন দুদকে আসতেন। ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলার তারাই সব সাজিয়ে দেন। এমনকি একজন আইনজীবীও সঙ্গে নিয়ে আসতেন যিনি আইন সংক্রান্ত নানা পরামর্শ দিতেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের নির্দেশনায় দুদকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ ও দুই কমিশনার মো. জহুরুল হক (তদন্ত) এবং মোসা. আছিয়া খাতুন (অনুসন্ধান) ব্যতিব্যস্ত ছিলেন। যখন যে বিষয়ে ওহী আসতো তা নিয়ে কাজ করার নির্দেশনা দিতেন কমিশনের কর্মকর্তাদের। ড. ইউনূসের মামলার বেলাতেও একই অবস্থা হয়েছিল বলে দুদকের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
আরেক কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের জন্য সিদ্ধান্ত হয়। সব কার্যক্রম শেষও হয়েছিল। অনুসন্ধান প্রতিবেদন প্রায় শেষ। এর মধ্যেই ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। ছাত্র আন্দোলনের মাঝামাঝি সময়ে কমিশনের পক্ষ থেকে মামলার প্রস্তুতি নিতে এক প্রকার চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল। তবে ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে সে অভিযোগ পরিসমাপ্তি করতে বলা হয়। এমন কি আগের মামলা থেকেও সরে আসে কমিশন।
এ বিষয়ে দুদকের মহাপরিচালক পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, পুরোটা ঠিক নয়। অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন ঘোলা পানিতে অনেকেই মাছ শিকার করতে চাইবে। এরকম কিছু ঘটেনি। সার্বিক বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করতে চাইলে মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহর মুঠোফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। অন্যদিকে কমিশনার (তদন্ত) মো. জহুরুল হককে দুই বার কল করা হয়। কিন্তু তিনি তা রিসিভ করেননি। দুদকের সচিব খোরশেদা ইয়াসমীনকে কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।