সর্বশেষ
Home » অপরাধ » দুর্নীতি » মুহসীন হলে অপহরণ ঘটনার পরও ঢাবির হল প্রশাসন নির্বিকার

মুহসীন হলে অপহরণ ঘটনার পরও ঢাবির হল প্রশাসন নির্বিকার

গত ২৫শে ফ্রেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে অপহরণের একটি ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। পাওনা টাকা আদায়ের জন্য এক ব্যবসায়ীকে তুলে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই হলে পালাক্রমে তিনদিন আটকে রাখা হয়। এ সময় তাকে মারধরের অভিযোগও ওঠে। থানায় ভুক্তভোগীর স্ত্রীর অভিযোগের  পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহায়তায় পুলিশ হল থেকে তাকে উদ্ধার করে। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে আটকও করা হয়। তিনজনই এক সপ্তাহ পর জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ‘ব্যবসায়ীকে অপহরণ করা হয়নি’ বলে দাবি করেন। এই ঘটনার পর ঢাবির আবাসিক হলে নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক তদারকির অভাব নতুন করে সামনে আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোর পরিচালনা পদ্ধতির একসময় বেশ সুনাম ছিল। তবে সেটি এখন অতীত। মেয়েদের হলগুলোতে আংশিক নিয়ন্ত্রণ থাকলেও ছেলেদের হলগুলোতে নেই ন্যূনতম প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ।

হলগুলোতে শিক্ষার্থীদের সিট প্রদানসহ সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা। তবে সিট দেয়ার ক্ষমতা না থাকলেও একটি সময় পর্যন্ত প্রশাসনিকভাবে খোঁজখবর রাখা হতো হলে থাকা আবাসিক শিক্ষার্থীদের। হল প্রভোস্টসহ প্রতিটি ফ্লোরের দায়িত্বপ্রাপ্ত হাউস টিউটররা নিয়মিত শিক্ষার্থীদের খোঁজখবর রাখতেন। তাদের সমস্যা, সুবিধা-অসুবিধার কথা শুনে নিতেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও। গত কয়েক বছরে সেই দৃশ্য একেবারেই বিরল। প্রশাসনিক কাজ সম্পন্ন করতে প্রভোস্টরা হল অফিসে আসলেও বেশির ভাগ হলেই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের সরাসরি সম্পৃক্ততা নেই। ছাত্রদের বিভিন্ন হলে থাকা আবাসিক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুধু দুই একটি হলেই  প্রভোস্টরা বিভিন্ন ফ্লোরে গিয়ে ও সরাসরি কথা বলে নিয়মিত তাদের খোঁজখবর রাখছেন।  হাউস টিউটদের অবস্থা আরও খারাপ। 

মূলত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের বিষয়টি দায়িত্বপ্রাপ্ত আবাসিক শিক্ষকদের উপরেই বর্তায়। তবে তারা সে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন না। তাদের সপ্তাহে অন্তত দুইবার হল ও ফ্লোর পরিদর্শন করার কথা থাকলেও কোনো হলেই সেটি সঠিকভাবে করেন না। এমনকি কোনো কোনো হলে কয়েক মাসেও দেখা মেলে না হাউস টিউটরদের।  প্রতিটি হলে শিক্ষার্থীদের ভালো-মন্দ দেখভাল করার জন্য হাউস টিউটরদেরকে নিয়োগ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তাদের প্রত্যেককে হলের বিভিন্ন ফ্লোরে দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হয়। হলের পাশেই শিক্ষক কোয়ার্টারে তারা থাকেন। তবে কাছাকাছি থেকেও হলগুলোতে তারা এতটাই অনিয়মিত যে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী এসব টিউটরদের চেনেনই না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে বারবার তাগদা দেয়া হলেও তাদের দায়িত্ব অবহেলার বিষয়টি দূর করা সম্ভব হয়নি।

 এমনকি সেই অপহরণের ঘটনার পরেও কোনো হলেই বাড়েনি হাউস টিউটরদের তৎপরতা। হলের ডিবেটিং, রক্তদান, ক্রীড়াসহ বিভিন্ন সংঠনগুলোর টুকটাক খোঁজখবর রেখেই দায়িত্ব সারছেন অনেকে।  প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে হলগুলোতে অনিয়ম  ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সরজমিন ছাত্রদের বিভিন্ন হল ঘুরে দেখা যায়, যে কেউ চাইলে অবাধে প্রবেশ করতে পারেন হলগুলোতে। হলের সামনে প্রহরীরা থাকলেও সেটি নামে মাত্র। কে আসছেন, কোথায় যাচ্ছেন তার সঠিক জিজ্ঞাসা তারা করছেন না। শিক্ষার্থী কিংবা রাজনৈতিক নেতার পরিচয়ের সূত্রে বহিরাগতরা নিয়মিত আসছেন হলে। এমনকি বিভিন্ন হলে থাকছেন দিনের পর দিন।   এ ছাড়াও কোনো ধরনের জবাবদিহিতা না থাকায় প্রতিটি হলে বেড়েছে মাদকসেবন। হাজী মুহাম্মদ মহসিন হল, মাস্টারদা সূর্যসেন হল, বিজয় একাত্তর, স্যার এএফ রহমান হলসহ প্রতিটি হলে অন্তত ডজনখানেক রুমে প্রতিদিনই নিয়ম করে চলে গাঁজাসহ অন্যান্য মাদক সেবন। মাদক সেবনকারীরা প্রভাবশালী বিধায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা এ নিয়ে প্রশাসনের কাছে মুখ খোলার সাহস পান না। প্রতিবাদ করতে গেলে অনেক ক্ষেত্রে আসে হুমকিও।  

সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্পট ও আশপাশের এলাকা থেকে গাঁজা, মদসহ নানা ধরনের  মাদক কিনে একদল শিক্ষার্থী প্রতিদিন হলে নিয়ে আসছেন কোনো ধরনের বাধা-বিপত্তি ছাড়াই। রুমের বাইরেও অনেক হলের ছাদে নিয়ম করে বসে গাঁজার আসর। মাদকের উদ্ভট গন্ধ, আসক্তদের অসংলগ্ন আচরণে নিয়মিত বিপাকে পড়েন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তাদের ভাষ্য, হলে ন্যূনতম প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ থাকলেও এ ধরনের অপরাধ প্রবণতা অনেকাংশে কমে আসতো। এ বিষয়ে প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির সাবেক সভাপতি ও বিজয় একাত্তর হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. আব্দুল বাছির মানবজমিনকে বলেন, এটা আসলে সত্য যে, যেভাবে হাউস টিউটরদের হলের শিক্ষার্থীদের খোঁজখবর রাখা উচিত তারা সেটি রাখছেন না। হাউস টিউটররা নিয়মিত হলে হলের প্রশাসনিক শৃঙ্খলা আরও বৃদ্ধি পেতো। এ বিষয়ে মাননীয় ভিসি মহোদয় নির্দেশনা দিয়েছেন। আশা করছি সামনের দিনগুলোতে এ পরিস্থিতির উন্নতি হবে। গত বছরের নভেম্বরে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে হলগুলোতে প্রশাসনের অবস্থান শক্ত করতে নানা উদ্যোগ নিয়েছেন বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. এস এম মাকসুদ কামাল।

 এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে এখনো পূর্ণ প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। হাউস টিউটরদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করার জন্য বারবার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। দ্রুতই তাদেরকে নিয়ে একটি সভা  করারও পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের। এখানে তাদের আরও স্পষ্টভাবে নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে জানিয়ে দেয়া হবে। দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করলে হাউস টিউটরদেরকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার পাশাপাশি প্রয়োজনে ব্যবস্থা নেয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলে ভিসি উল্লেখ করেন। হাউস টিউটররা দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন কিনা এটি তদারকিতে সামনে একটি অ্যাপও উদ্বোধন করা হবে বলে জানান তিনি। যেখানে প্রতিটি হাউস টিউটরকে নিয়মিত হল পরিদর্শন ও নিজের কাজ সম্পর্কে তথ্য দিতে হবে। হলগুলোতে অনিয়মের বিরুদ্ধে নিজের কঠোর অবস্থানের কথা উল্লেখ করে ভিসি বলেন, মাদক ও বহিরাগতসহ হলগুলোতে কোনো অনিয়মের তথ্য-প্রমাণ  পেলেই আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। অনিয়ম করে কারও পার পাওয়ার সুযোগ নেই। অভিযোগ প্রমাণিত হলে সবার বিরুদ্ধেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে সে যেই হোক না কেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *