একটা ক্রিকেট ম্যাচ মাঠে গড়ালে সেখানে কেউ রান করবে, কেউ উইকেট পাবে, কেউ ক্যাচ ধরবে- এটাই স্বাভাবিক। তবে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের শরীরী ভাষা, খেলার ধরন, আউট হওয়ার ভঙ্গিমা সবকিছুর ভেতরই অদ্ভুত এক ছন্নছাড়া ভাব। কেউ যদি জার্সির রঙ না জানেন, তাহলে খেলাটা দেখলে মনে করতে পারেন যুক্তরাষ্ট্রের দলটাই হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা দল আর বাংলাদেশ হচ্ছে পাড়ায় নতুন। এতো গেল মাঠের পারফর্ম্যান্স, তাতে তো লজ্জার শেষ নেই। তবে মাঠের খেলা শেষে সংবাদ সম্মেলনে ক্রিকেটাররা যেভাবে কথা বলেন তাতে হারের কোনো রেশ তাদের মধ্যে দেখা যায় না। প্রথম ম্যাচ শেষে অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত বা দ্বিতীয় ম্যাচ শেষে সাকিব আল হাসান, দুজনেই যেন অযুহাতের মেলা বসালেন। আর তাতে প্রশ্ন তৈরী হয়, লজ্জার হারের পর তাদের এমন দাম্ভিকতা আসে কোথা থেকে!
সিরিজের প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশ আগে ব্যাটিং করে হেরেছিল, এবার পরে ব্যাটিং করে হেরে দেখিয়ে দিলো যে সবরকমভাবেই তারা হারতে প্রস্তুত। খেলায় হারজিত থাকবেই, তাই বলে এমন দলের বিপক্ষে হার। অপেশাদার, অভিবাসী খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া একটা দল হারিয়ে দিলো ২৪ বছর ধরে টেস্ট খেলা পুরোদস্তুর পেশাদার এবং দেশের গণ্ডিতে ঈর্ষণীয় তারকাখ্যাতি পেয়ে আসা দলটাকে।
বৃহস্পতিবার, দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টির একাদশে লিটন দাস ছিলেন না; তানজিদ হাসান তামিম এসেছেন তার জায়গায়। তাতেও উদ্বোধনী জুটিতে ভালো শুরু বা পাওয়ার প্লেতে ভালো রান, কিছুই দেখা যায়নি।
সাকিব-মাহমুদউল্লাহদের নিয়ে গড়া ব্যাটিং অর্ডার ২০ ওভারে ১৪৫ রান তাড়া করতে পারেনি। বোলাররা পারেনি আগের ম্যাচে শেষ ৪ ওভারে ৫৫ রান ডিফেন্ড করতে। তাহলে এতো এতো কোচিং স্টাফ আর এতো সুযোগ- সুবিধার মূল্য কি? যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে বাংলাদেশ দল এমন করছে তা কিন্তু নয়। ধারাবাহিকভাবেই ক্রিকেটারদের পারফরমেন্স গড়পরতা। সবশেষ ওয়ানন্ডে বিশ্বকাপেও নেদারল্যান্ডের কাছে হেরেছিল বাংলাদেশ। যে দলটি উগান্ডার কাছে করে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সুযোগ হাতছাড়া করেছে সেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সর্বশেষ সিরিজ জিততে ঘাম জড়াতে হয়েছে শান্তদের। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলতে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার আগে টি-টোয়েন্টি জয়ের একটা ফর্মুলা দিয়েছিলেন বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত। এতে অবশ্য তার মূল ভরসা ছিল বোলিং ইউনিট। আগে ব্যাট করলে ব্যাটাররা ১৬০-১৭০ রান করবেন। আর মিতব্যয়ী বোলিংয়ে বোলাররা ম্যাচ জেতাবেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে প্রথম শর্তই পূরণ করতে পারেননি বাংলাদেশের ব্যাটাররা। ঘরের মাঠে সদ্য শেষ হওয়া জিম্বাবুয়ে সিরিজের পর, যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে প্রথম দুই ম্যাচেই ব্যর্থ টাইগার ব্যাটাররা। এমন হারের জন্য স্বাভাবিকভাবে কাঠগড়ায় ওঠার কথা ব্যাটারদের।
সিরিজ হারের ম্যাচে সংবাদ সম্মেলনে আসেন সাকিব আল হাসান। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি যে ভঙ্গিতে উত্তর দিয়েছেন তাতে মনে হচ্ছিল মাঠে কি হয়েছে সেটা বোধহয় তিনি জানেনই না। এই ব্যর্থতার কারণ জানতে চাইলে আয়েশী ভঙ্গিতে সাকিব বলেন, ‘এটা তো আমি জানি না। আমি জানলে দলকে বলতাম তাহলে ফলাফল অন্য রকম হতো।’
টানা দুই ম্যাচে ব্যর্থ ছিল বাংলাদেশের টপ অর্ডার ব্যাটাররা। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের সঙ্গে যেন মানাতেই পারছেন না তারা। আসলে মূল সমস্যাটা কোথায়? সাকিবের কাঠখোট্টা উত্তর, ‘আমি বলতে পারবো না। এটার জবাব আমার কাছে নেই।’
অথচ দ্বিতীয় ম্যাচ হারের দায় কোনো অংশেই তিনি এড়াতে পারেন না। তখন ৩ ওভারে বাংলাদেশের প্রয়োজন ২১ রান। ২২ বলে ৩০ রান নিয়ে ব্যাটিং করছেন সাকিব, উইকেটে তিনি একাই স্বীকৃত ব্যাটার। ওই ওভারের প্রথম বল বাইরে থেকে টেন এনে বোল্ড হন সাকিব। অথচ তখন দায়িত্ব নিয়ে ম্যাচ বের করে আনার কথা ছিল তার। তবে সেটা না পারলেও সংবাদ সম্মেলনে মুখের কথাতেই যেন জিতে যেতে চাইলেন বাংলাদেশের সবচেয়ে অভিজ্ঞ এই অলরাউন্ডার।
র্যাঙ্কিংয়ে ১৯ নম্বর দল যুক্তরাষ্ট্র, অন্যদিকে বাংলাদেশের অবস্থান ৯ নম্বরে। স্বাগতিকদের হালকাভাবে নিয়েছে কিনা বাংলাদেশ, এমন প্রশ্নের উত্তরে সাকিব বলেন, ‘আপনি তা বলতে পারেন, তবে আমার মনে হয় না। প্রথম ম্যাচে হয়তো আমরা যা চেয়েছি তা করতে পারিনি। পরের ম্যাচেও তা হলো। আমরা আমাদের প্ল্যান কাজে লাগাতে পারিনি। আমার মনে হয়নি পিচ অত খারাপ ছিল। আমরা ভালো ব্যাট করিনি। আমাদের আরও ভালো ব্যাট করা উচিত ছিল।’
এমন পারফরম্যান্সের প্রভাব বিশ্বকাপে পড়তে পারে কিনা প্রশ্নেও উদাসীন সাকিব। যেন কিছুতেই তার কিছু যায় আসে না। সাকিব বলেন, ‘অবশ্যই পড়তে পারে, আবার নাও পড়তে পারে।’
প্রথম ম্যাচ হারের পর ঘরের মাঠে খেলা জিম্বাবুয়ে সিরিজের উইকেটকে দায় দেন অধিনায়ক শান্ত। আর এবার সাকিব টেনে আনলেন এই ম্যাচের আগে প্রস্তুতিতে তৈরি হওয়া ঘাটতিকে। আইসিসি’র সহযোগী দেশগুলোর সঙ্গে হারার পর যখন ক্রিকেটাররা এভাবে অদ্ভুত সব অযুহাত দেওয়া শুরু করেন, তখন প্রশ্ন জাগে বিশ্বকাপে বড় দলগুলোর বিপক্ষে হারের তারা আসলে কীভাবে নিজেদের ডিফেন্ড করবেন।
সাকিব বলেন, ‘ম্যাচের আগে আমরা একদিন প্রোপার নেট সেশন পেয়েছি। তাও ব্যাটারদের যতটুকু ব্যাটিং অনুশীলন করার দরকার ছিল তারা সেটা করতে পারেনি। আমার কাছে সেটাকে আদর্শ মনে হয়নি। একদিন ছিল ঐচ্ছিক, সেখানে ব্যাটাররা সুযোগ নেয়নি। আপনি দুটোতেই দোষ দিতে পারেন। যেদিন সুযোগ ছিল সেদিন কেন ব্যাটাররা এসে ব্যাটিং করলো না! আবার এটাও বলতে পারেন, যেহেতু আমরা (বিশ্বকাপের) প্রস্তুতিমূলক সিরিজ হিসেবে নিয়েছিলাম, কেন আমরা এ সুবিধাগুলোগুলো নিতে পারলাম না। দুই দিকেরই ব্যর্থতা আছে। এই জিনিসগুলো আমাদের অনেক ভালো হওয়ার দরকার ছিল।’
অবশ্য বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের এমন দাম্ভিকতার নজির নতুন নয়। প্রথম ম্যাচ হারের পর শান্ত বলেছিলেন ব্যাটারদের ব্যর্থতা নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। তিনি বলেন, ‘(ব্যাটিং) নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। কারণ, প্রত্যেক ব্যাটারই তাদের দক্ষতা নিয়ে কাজ করছে। আমরা সবাই জানি, টপ অর্ডারকে ভালো খেলতে হবে। ব্যাটিং ইউনিটের খারাপ করার জন্য আমরা সবাই দায়ী। ব্যাটাররা এটা নিয়ে কাজ করছে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে এই জায়গায় কাজ করছি। আমরা আশা করি, পরের ম্যাচ থেকে ভালোভাবে ফিরে আসবো।’
এর আগে দারুণ ছন্দে থাকা অবস্থায় লিটন দাসও সংবাদ সম্মেলনে নানাভাবে প্রশ্নের উত্তরে দাম্ভিকতা দেখিয়েছেন। সাংবাদিকদের পাল্টা প্রশ্ন করাই যেন তাদের পছন্দের কাজ। অথচ তাদের উচিত ছিল সমস্যার সমাধান খোঁজা। কিন্তু সাংবাদিকরা সমস্যা নিয়ে প্রশ্ন করলেই যেন তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন টাইগার ক্রিকেটাররা।
শান্ত বারবার দাবি করছেন ব্যাটিং নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। কিন্তু বিশ্বকাপ যতই এগিয়ে আসছে, ততই চিন্তা বাড়ছে বাংলাদেশের ব্যাটিং নিয়ে। বিশেষ করে বাংলাদেশের টপ অর্ডার ব্যাটিং নিয়ে দুশ্চিন্তাটা ক্রমশই বাড়ছে। এভাব চলতে থাকলে আরও একটি বিশ্বকাপে খালি হাতে ফেরার পথ ধরতে হবে। যেমনটা হয়েছিল সবশেষ ওয়ানডে বিশ্বকাপে। গেল বছর ভারতে ওয়ানডে বিশ্বকাপে দলের ভরাডুবির পর প্রধান কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে বলেছিলেন- দলটি তার নয়। ৭ মাস আগে দায়িত্ব নিয়েও তিনি ব্যর্থতার দায় কাঁধে নেননি। তবে যুক্তরাষ্ট্র-ওয়েস্ট ইন্ডিজ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে অনেক সময় পেয়েছেন। জানা গেছে, নির্বাচকদের ইচ্ছার মূল্যায়ন না করেই নিজের পছন্দের স্কোয়াড সাজিয়েছেন। যেখানে ফর্মহীনতার পরেও তার প্রিয় দুই শিষ্য সৌম্য সরকার ও লিটন কুমার দাসকে দলে রেখেছেন। তাদের নানা আন্তর্জাতিক সিরিজে খেলিয়ে ফর্মে ফেরানো চেষ্টা করছেন। কিন্তু তারা গুরুর আস্থার প্রতিদান দিতে পারছে না। টপ অর্ডারে তাদের ব্যর্থতায় চাপ বাড়ছে পরের ব্যাটারদের উপর। যদিও এ নিয়ে কোনো কথা হেলদোল নেই হাথুরুসিংহের। তবে হারের পর একজন এক রকম ব্যাখ্যা দিয়ে যাচ্ছেন। এই যেমন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রথম ম্যাচ হারের পর জিম্বাবুয়ে সিরিজের ‘পিচ’কে অযুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়েছিলেন অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত। সিরিজ খোয়ানোর পর সাকিব আল হাসান বললেন প্রস্তুতির ঘাটতির কথা। কিন্তু এদের কেউই আসল কথা বললেন না। যা বলছেন ক্রিকেট কোচ নাজমুল আবেদিন ফাহিম। দু’দিন আগে মানবজমিনকে তিনি বলেছিলেন, এই দলের লিটন, সৌম্য, শান্তর টি-টোয়েন্টি খেলার ক্যাপাসিটি নাই। এই ক্যাপাসিটি ছাড়া খেলোয়াড়দের নিয়ে কীভাবে টি-টোয়েন্টি ফল পাবে বাংলাদেশ!